Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ বিজন ভট্টাচার্য :

বাংলা নাট্যরচনার চিরাচরিত ঐতিহ্য থেকে সরে এসে সাধারণ মানুষের জীবনসমস্যার কথা সাধারণ মানুষকে দেখাবার উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক রচনায় যাঁরা ব্রতী হ...


বাংলা নাট্যরচনার চিরাচরিত ঐতিহ্য থেকে সরে এসে সাধারণ মানুষের জীবনসমস্যার কথা সাধারণ মানুষকে দেখাবার উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক রচনায় যাঁরা ব্রতী হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিজন ভট্টাচার্য—যিনি গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ ছিলেন। শুধু নাট্যরচনা নয়, অভিনয় ও নাট্যপ্রযোজনার ক্ষেত্রেও তাঁর প্রশংসনীয় ভূমিকা ছিল। তাঁর নাটক রচনার উৎস হল মানুষের প্রতি তার সহমর্মিতা–যা তীক্ষ্ণ সমাজদৃষ্টি থেকে উদ্ভূত।

     পরিচয় :     
        ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই জুলাই বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার খান খানাপুর গ্রামে নাট্যকার জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ক্ষীরোদবিহারী ও মা সুবর্ণপ্রভা দেবীর প্রথম সস্তান ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। ১৯৩০ সালে পড়াশোনার জন্য কলকাতায় আসেন। ছাত্র আন্দোলন, লবণ সত্যাগ্রহ ও অসহযোগ আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার জন্য লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে। ১৯৩৮-৩৯ সালে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকায় যোগদান করেন। সেইসময় প্রগতিশীল মানুষদের সাহচর্যে মার্কসীয় দর্শনের প্রতি আকৃষ্ট হন।  ১৯৪৪-এ আনন্দবাজারের চাকরি ছেড়ে কমিউনিস্ট পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে যান। তার আগে ১৯৪২-এ ‘ফ্যাসীবিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘ’ সংগঠিত হলে তিনি তার সঙ্গে যুক্ত হন। এই শিল্পীসংঘ ও গণনাট্য সংঘের সঙ্গে যুক্ত থেকেই তাঁর নাট্যজীবনের সূত্রপাত ও বিকাশ। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে মনীশ ঘটকের কন্যা সুলেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে বিবাহ হয়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করে পুত্র নবারুণ। বিবাহিত জীবন অবশ্য বেশিদিন টেকেনি। ক্ষয়রোগে আক্রান্ত হন তিনি এবং ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।

    প্রথম রচনা :   
(a) প্রথম একাঙ্ক নাটক - ‘আগুন’ - ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ এপ্রিল ‘অরণি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
(b) প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক ‘নবান্ন’ - ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘অরণি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।


   নাটকের শ্রেণী বিভাজন :  
            বিজন ভট্টাচার্য পঁচিশটিরও বেশি নাটক রচনা করেছেন। তাঁর নাট্যগুলোকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে :
   পূর্ণাঙ্গ নাটক :    
  • 'নবান্ন' (১৯৪৪), 
  • 'অবরোধ' (১৯৪৭), 
  • 'জতুগৃহ' (১৯৬২), 
  • 'গোত্রান্তর' (১৯৫১), 
  • ‘ছায়াপথ' (১৯৬২), 
  • 'মাস্টারমশাই' (১৯৬১), 
  • ‘দেবীগর্জন' (১৯৬৯), 
  • 'কৃষ্ণপক্ষ' (১৯৬৬), 
  • ‘ধর্মগোলা' (১৯৬৭), 
  • 'আজ বসস্ত' (১৯৭০), 
  • 'গভবতী জননী' (১৯৬৯),
  •  ‘সোনার বাংলা' (১৯৭১), 
  • 'চলোসাগরে' (১৯৭২) ইত্যাদি।
 
  একাঙ্ক নাটক :    
  • 'আগুন' (১৯৪৩), 
  • 'জবানবন্দি' (১৯৪৩), 
  • 'মরাচাঁদ' (১৯৪৬), 
  • 'কলঙ্ক' (১৯৫০), 
  • 'জননেতা' (১৯৫০), 
  • 'সাগ্নিক' (১৯৬৮), 
  • 'লাস ঘুইর্যা যাউক' (১৯৭০), 
  • 'চুল্লি' (১৯৭৪), 
  • 'হাঁসখালির হাঁস' (১৯৭৭)।

   রূপক নাট্য :   
  • 'স্বর্ণ কুম্ভ' (১৯৭০)

    গীতিনাট্য :     
  • 'জীয়নকন্যা' (১৯৪৮)।

    নাট্যরূপায়ণ :      
  • 'গুপ্তধন' (১৯৭২), 
  • 'নীলদর্পণ' (১৯৭২) নাটক ।

   চিত্রনাট্য রচনা :    
  • 'নাগিন', 
  • 'বসুপরিবার', 
  • 'সাড়ে চুয়াত্তর', 
  • 'ডাক্তারবাবু', 
  • 'তৃষ্মা' ইত্যাদি। 

   অন্যান্য রচনা :   
  • 'জালসত্ত্ব' (ছোটো গল্প/১৯৪০), 
  • 'জনপদ' (উপন্যাস/১৯৪৫), 
  • 'জলসা' (ছোটোগল্প/১৯৪৬), 
  • 'রাণীপালঙ্ক' (উপন্যাস/১৯৬০),
  •  ‘সোনালী মাছ’ (উপন্যাস/১৯৬২) ইত্যাদি।

    নাটক আলোচনা :    
   (১) ‘আগুন’ :    
  • প্রথম একাঙ্ক নাটক ।
  •  ‘আগুন’ - ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৩ এপ্রিল ‘অরণি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
  • ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে গণনাট্য সংঘ দ্বারা নাট্যভারতী অভিনয় মঞ্চে অভিনীত হয় ।
  • নাটকটি পাঁচটি দৃশ্যে রচিত । 
  • ক্ষুধার জ্বালায় মানুষের মধ্যে যে সমন্বয়ী শক্তির বিকাশ লক্ষ্য করা যায়, তাই ‘আগুন‘ নাটকের বক্তব্য বিষয় ।
  • নাটকটি পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় নি ।  

   (২) ‘জবানবন্দি’ :    
  • ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ অক্টোবর ‘অরণি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
  • ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে স্টার থিয়েটারে গণনাট্য সংঘ কর্তৃক অভিনীত হয় ।
  • এই নাটকের নির্দেশনা ও বেন্দা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন নাট্যকার স্বয়ং ।
  • এই নাটকের মাধ্যমে প্রথম নূতনত্বের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। 
  • কিভাবে গ্রামের অসহায় মানুষেরা মহামারী, ক্ষুধা, রোগে পতিত হয়ে ঘরছাড়া হয় ও শহরে এসে লোভ-লালসার শিকার হয় তারই মর্মন্তুদ চিত্র নাটকে বর্ণিত হয়েছে।
  •  নাট্যকার নাটকটি সম্পর্কে নিজেই জানিয়েছেন, 
‘সেও এক সোনা ধানের দুঃস্বপ্ন-মাঠের রাজা পরাণ মণ্ডল (জবানবন্দী'র নায়ক) যে স্বপ্ন দেখতে দেখতে কোলকাতার ফুটপাথে না খেতে পেয়ে হুমড়ি খেয়ে মরেছিল।'
 
   (৩) ‘নবান্ন’ :    
  • বিজন ভট্টাচার্যের লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নাটক ‘নবান্ন’।
  • নাটকটি ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দে ‘অরণি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
  • নাটকটি চারটি অঙ্ক ও পনেরোটি দৃশ্যে রচিত ।
  • গণনাট্য সংঘ শ্রীরঙ্গম মঞ্চে ১৯৪৪-এর ২৪শে অক্টোবর এই নাটক প্রথম অভিনীত হয়।
  • নাটক নির্দেশনায় ছিলেন বিজন ভট্টাচার্য এবং শম্ভু মিত্র।
  • প্রধান সমাদ্দারের ভূমিকায় স্বয়ং নাট্যকার অভিনয় করেন।
  • ১৯৪২-এর সাইক্লোন ও জলোচ্ছাসে যখন পশ্চিমবঙ্গের উপকূলবর্তী অঞ্চল প্রচণ্ড ক্ষত-বিধ্বস্ত হয় এবং যার ফলে সেনাবাহিনীর জন্য খাদ্য মজুত করতে গিয়ে ভয়াবহ মন্বন্তর (১৩৫০) দেখা দেয়—সেই পটভূমি ‘নবান্ন’ নাটকের প্রেক্ষাপট।
  • এই নাটক সম্পর্কে স্বয়ং নাট্যকার বলেছেন, 
“ঘরে যেদিন অন্ন ছিল না, নিরন্নের মুখ চেয়ে সেদিন আমি নবান্ন লিখেছিলাম। নাটক আরম্ভ করেছিলাম ১৯৪২ সালের জাতীয় অভ্যুত্থান আগস্ট আন্দোলনকে স্বাগত জানিয়ে।”

   (৪) ‘অবরোধ’ :    
  • ‘অবরোধ’ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৩৫৪ সালের পৌষ মাসে।
  • নাটকটি মোট ছয়টি অঙ্ক ও বারটি দৃশ্যে নাটকটি বিন্যস্ত।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে বাংলার শ্রমিকদের দুরবস্থা, মালিকপক্ষের শ্রমিক শোষণ এবং প্রতিবাদী শ্রমিক শ্রেণির আন্দোলন এই নাটকের প্রধান বিষয়। 
  • নাটকে ওসমান, গজানন ও রেবতীবাবুর চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
  • গণনাট্য সংঘ এ নাটকটি অভিনয় করেনি।

   (৫) ‘জীয়নকন্যা’ :    
  • ১৯৪৮ সালে 'জীয়নকন্যা' নামক গীতিনাট্যটি প্রকাশিত হয়। 
  • এটি একটি অপেরাধর্মী নাটক। 
  • নাটকটি ‘রঙমহল’ মঞ্চে প্রথম অভিনীত হয় ।
  • ১৭/৮/১৯৪৮-এ এটি আকাশবাণী কলকাতা থেকে সম্প্রচারিত হয়।

   (৬) ‘মরাচাঁদ’ :    
  •  ক্যালকাটা থিয়েটারের জন্য ‘মরাচাঁদ’ নাটক রচনা করেন ।
  • ১৯৪৬ সালে ‘মরাচাঁদ’ রচনা করেন ।
  • ‘মরাচাঁদ’ ১৯৫২তে প্রথম অভিনীত হয়। 
  • নাটকে চব্বিশ পরগণার এক অন্ধ গায়কের জীবন চিত্রিত হয়েছে। 
  • নিউ এম্পায়ার মঞ্চে ১৯৬১ সালের ৩১শে মার্চ ক্যালকাটা থিয়েটার এই নাটক অভিনয় করে। নাট্যকার এই নাটকের নির্দেশনা, সঙ্গীত পরিচালনা এবং পবন ও কেতকের দ্বৈত চরিত্রে অভিনয় করেন।
  • পরবর্তীকালে নাট্যকার এই নাটকটিকে পূর্ণাঙ্গ নাটকের মর্যাদা দেন ।
   (৭) ‘দেবীগর্জন’ :    
  • দেবীগর্জন’ ১৯৬৬তে লিখিত হলেও গ্রন্থাকারে তা প্রকাশিত হয় ১৯৬৯ সালে। 
  • ১৯৬৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১শে ফেব্রুয়ারী ক্যালকাটা থিয়েটার প্রথম অভিনয় করে। 
  • ‘কলঙ্ক’ নাটিকার কিছুটা অংশ নিয়ে এই নাটক রচিত ।
  • আক্ষরিক অর্থে দেবীগর্জনের অর্থ  - বসুধার গর্জন।
  • দেবীগর্জনের কাহিনির মূলে রয়েছে ‘কৃষক আন্দোলনের পটভূমি'। 
  • ‘জবানবন্দী’র আশা, ‘নবান্নে’র ভরসা, ‘দেবীগর্জনে’ এসে নির্দিষ্ট রূপ লাভ করেছে। 
  • গ্রামের কৃষক নির্যাতন ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এই নাটকে সংঘটিত হয়েছে। 
  • ঊষর লাল মাটির দেশ বীরভূমের পটভূমিতে আদিবাসী ও সাঁওতাল চাষীদের কৃষক আন্দোলনের ভিত্তিতে এই নাটকটির নামকরণ। 
  • নাটকটি ট্রাজেডি নাটক।

   (৮) ‘হাঁসখালির হাঁস’ :    
  • হাঁসখালির হাঁস' ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দের 'সপ্তাহ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। 
  • এটি বিজন ভট্টাচার্যের লেখা শেষনাটক। 
  • কলকাতার পাতাল রেলের জন্য মাটি খুঁড়তে আসা শ্রমিকদের নিয়ে এই নাটকটি রচিত হয়েছে। 
  • এই নাটকে ক্ষুধা, ঠিকাদারের অত্যাচারের, বৃদ্ধ শ্রমিকের মৃত্যু, নতুন জন্ম নেওয়া সম্ভানের কান্না, শিল্পসাথকভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।

   ‘নবান্ন নাটকের অভিনবত্ব :   
        বাংলা নাটক ও থিয়েটারের ইতিহাসে ‘নবান্নে’র অভিনবত্বের দিকগুলি হল :
(ক) বিষয়বস্তু, 
(খ) ভাব, 
(গ) চরিত্রসৃষ্টি, 
(ঘ) সংলাপ, 
(ঙ) সঙ্গীত, 
(চ) গঠনশৈলী,
(ছ) রঙ্গমঞ্চে উপস্থাপনা।

   নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের কৃতিত্ব :    
(i) আধুনিক যুগের বাংলাদেশে নবনাট্য আন্দোলনের যে সূত্রপাত তার প্রথম প্রকাশ বিজন ভট্টাচার্যের নাটকের মধ্যে। 
(ii)চির পরিচিত চরিত্র, অস্বাভাবিক নতুনত্বের দীপ্তি নিয়ে সেদিন জনগণের মনে বিস্ময়ের ও নবচেতনার ঢেউ তুলেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। 
(iii) বিজন ভট্টাচার্যের শিল্পী প্রতিভার মধ্যে ছিল প্রতিরোধ ও প্রতিবাদী মানসিকতা। তাই শুধু 'নবান্ন' নয়, প্রায় সব নাটকই দুর্গতি ও প্রতিরোধের নাটক। 
(iv) বিজন ভট্টাচার্যের নাটকে সাধারণ মানুষের জীবন সমস্যাই বেশি রূপ পেয়েছে।
(v) বাংলা রঙ্গমঞ্চের ইতিহাসে তার নাটকগুলি পেশাদারি রঙ্গমঞ্চের ধারা থেকে সরে এসে অভিনব নাট্যধারার সূচনা করল। 
(vi) বিজন ভট্টাচার্যের নাটক যেহেতু সাধারণ মানুষের জীবন সমস্যা এবং তা সাধারণ মানুষকে সচেতন করবার জন্য, সেজন্য নাটকে লৌকিক জীবন ও সংস্কৃতির রূপ প্রাধান্য পেল। 

No comments