ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা কাব্যজগতে ঈশ্বর গুপ্ত ও মধুসূদনের মধ্যে যাঁর আবির্ভাব হয়েছিল, তিনি হলেন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭) । ...
ঊনবিংশ শতকের মধ্যভাগে বাংলা কাব্যজগতে ঈশ্বর গুপ্ত ও মধুসূদনের মধ্যে যাঁর আবির্ভাব হয়েছিল, তিনি হলেন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮২৭-১৮৮৭)। গুরু ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় তাঁর প্রথম কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ। ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ বাংলা কাব্যে ঐতিহাসিক কাব্যের সূত্রপাত করলেন। তাই সুকুমার সেন যথার্থই বলেছেন,
“ইংরেজী কাহিনী-কাব্যের রোমান্স রসের যোগান দিয়া রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় নবযুগের দিকে বাঙ্গালা সাহিত্যের মুখ ফিরাইলেন, অবাস্তর কাল্পনিক পরিবেশে স্থূল প্রণয়লীলার স্থানে তিনি ঐতিহাসিক পটভূমিকায় দেশপ্রেমকে কাব্যের বিষয়রূপে গ্রহণ করিলেন।”
পরিচয় :
হুগলী জেলার বাকুলিয়া গ্রামে ১৮৭২ খ্রিষ্টাব্দে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মগ্রহন করেন । পিতা - রামনারায়ন এবং মাতা হরসুন্দরী দেবী । গ্রামের পাঠশালায় প্রথম শিক্ষাগ্রহন শুরু করেন । পরে মিশনারী স্কুলে শিক্ষা শেস করে হুগলীর মহসিন কলেজ থেকে পড়াশোনা করেন । গুরু ঈশ্বর গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকায় তিনি সাহিত্য রচনা শুরু করেন । কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে কিছুদিন অধ্যাপনা করেন । আয়কর অ্যাসেসর ও ডেপুটি কালেক্টরের কাজ করেন । ১৮৮৭ সালের ১৩ মে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন ।
রচনা সমগ্র :
কাব্যগ্রন্থ :
- ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮)
- ‘কর্মদেবী’ (১৮৬২)
- ‘শূরসুন্দরী’ (১৮৬৮)
- ‘কাঞ্চীকাবেরী’ (১৮৭৯)
রঙ্গ - ব্যাঙ্গ মূলক রচনা :
- ‘ভেক মুষিকের যুদ্ধ’ (১৮৫৮)
অনুবাদ :
- ‘কুমারসম্ভবের অনুবাদ’ (১৮৭২)
- ‘ওমর খৈয়মের কবিতা’
সম্পাদিত রচনা :
- ‘কবিকঙ্কন চন্ডি’ (১৮৮২)
সম্পাদিত পত্রিকা :
- ‘মাসিক সংবাদ সাগর’ (১৮৫২)
- ‘এডুকেশন গেজেট’ (১৮৫৫)
- ‘বার্তাবহ’ (১৮৫৬)
অন্যান্য রচনা :
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের অন্যান্য রচনাগুলি হল—
- 'কলিকাতা কল্পলতা, (১৩৬৬, গল্পভারতী),
- ‘বঙ্গ বিদ্যার আদ্যবিবরণ’ (১২৫৬, এডুকেশন গেজেট),
- ‘বাঙ্গালা কবিতা বিষয়ক প্রবন্ধ' (১৮৫২ বেথুন সভায় পঠিত),
- 'উৎকল বর্ণন' (১৮৬৩, রহস্য সন্দর্ভ),
- 'কটকস্থ উৎকল ভাষোদ্দীপনী সভায় শ্রীযুক্তবাবু রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তৃতা’ (১৮৬৬, রহস্য সন্দর্ভ),
- 'দীননাথ দাস' (১৮৬৪),
- 'উপেন্দ্রভঞ্জ' (১৮৬৪, রহস্য সন্দর্ভ),
- ‘শরীর সাধনী বিদ্যা শিক্ষার গুণোৎকীর্ত্তন' (১৮৬০),
- ‘ইউরোপ ও এস্যা খণ্ডস্থ প্রবাদমালা’ (১৮৬৯) প্রভৃতি।
আলোচনা :
- রঙ্গলালের শ্রেষ্ঠ কাব্য 'পদ্মিনী উপাখ্যান' (১৮৫৮)।
- এই আখ্যান কাব্যের বিষয়বস্তু টড-এর রাজস্থান (Annals and Antiquities of Rajasthan)-এর কাহিনি অবলম্বনে রচিত।
- আলাউদ্দিনের চিতোর আক্রমণ এবং জহরব্রতে আগুন জ্বালিয়ে পদ্মিনীর আত্মাহুতি দানের কাহিনি অবলম্বনে এই কাব্য রচিত।
- এই কাব্যের মাধ্যমে কবি স্বদেশবাসীর মধ্যে যে জাতীয় গৌরব ও ভাবাবেগ সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন সে কারণে কাব্যটি উল্লেখযোগ্য হয়ে রয়েছে। বিশেষ করে ক্ষত্রিয়দের প্রতি রাজার উৎসাহবাক্য স্মরণীয় হয়ে রয়েছে—
- এই কবিতায় টমাস ম্যূরের “Glories of Brien the Brave এবং From life without Freedom" এর ছায়াপাত ঘটেছে।
‘‘স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে, কে বাঁচিতে চায়৷ / দাসত্ব শৃঙ্খল বল, কে পরিবে পায় হে, কে পরিবে পায়?”
(২) ‘কর্মদেবী’ :
- মধুসূদনের ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’ এবং ‘মেঘনাদবধ কাব্য' প্রকাশিত হওয়ার পরে রঙ্গলালের ‘কর্মদেবী’ কাব্য (১৮৬২) প্রকাশিত হয়।
- এই গ্রন্থের বিষয়বস্তুও রাজপুত কাহিনি থেকে নেওয়া ।
- কাব্যটি চার সর্গে বিন্যস্ত।
- নায়ক-নায়িকার আত্মত্যাগ ও সতীত্ব, মহিমা এবং নারী-প্রেমের রোমান্টিক মাধুর্য এই কাব্যে চিত্রিত হয়েছে।
- কাব্যে আদি ও করুণ রসের উৎসার ঘটেছে।
- সাধু এই কাব্যের নায়ক। সাধু স্বদেশভক্ত ও সাহসী বীর।
(৩) ‘শূরসুন্দরী’ :
- রঙ্গলালের তৃতীয় কাব্য ‘শূরসুন্দরী’ (১৮৬৮) ।
- কাব্যটি রাজপুত নারীর শৌর্যগাথা।
- নারীর সতীত্বরক্ষা এই কাব্যের প্রতিপাদ্য বিষয়।
- আকবরের প্রাসাদের এবং অন্তঃপুরের বর্ণনা কাব্যে প্রাধান্য লাভ করেছে।
(৪) ‘কাঞ্চীকাবেরী’ :
- ‘কাঞ্চীকাবেরী’ (১৮৭৯) রঙ্গলালের সর্বশেষ আখ্যান কাব্য।
- এর বিষয় উড়িষ্যার ইতিহাসের এক রোমান্টিক কাহিনি এই গ্রন্থের উপজীব্য।
- এই কাহিনি তাঁর নিজস্ব নয়।
- পুরুষোত্তম দাসের প্রাচীন উড়িষ্যা কাব্য তিনি অনুসরণ করেছেন।
- এর কাহিনি সাত স্বর্গে বিন্যস্ত।
- চতুর্থ সর্গ ছাড়া অন্য সর্গগুলিতে কবির কৃতিত্ব সমধিক।
- সুকুমার সেন এই কাব্যের আলোচনা প্রসঙ্গে লিখেছেন,
“কাঞ্চীকাবেরী’র বিষয় বেশ রোমান্টিক। তাহার উপর ভক্তিরসের প্রবাহ থাকায় অধিকতর হৃদয়গ্রাহী। ভাষা সরলতর এবং ছন্দপ্রবাহ সুললিত।”
(৫) ‘ভেক মুষিকের যুদ্ধ’ :
- রঙ্গলাল টমাস গারনেলের 'The Battle of the Frogs and Mice' কাব্য অবলম্বনে ‘ভেক মূষিকের যুদ্ধ’ (১৮৫৮) রচনা করেন।
- এটি বীররসাত্বক অনুবাদমূলক ব্যঙ্গ কাব্য।
- ”ভেকমুষিকের যুদ্ধ” কাব্যটি প্রথম ধারাবাহিক ভাবে 'এডুকেশন গেজেট' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
- মন্মথনাথ ঘোষ লিখেছেন,
“রেভারেণ্ড ও 'ব্রায়েন ইতিমধ্যে গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষায় শিক্ষা লাভ করেন। পার্ণেলের ইংরাজি অনুবাদ হইতে তিনি বোধ হয়। সাহায্য গ্রহণ করিয়াছিলেন, কিন্তু মূল গ্রিক কাব্য অবলম্বনেই তাঁহার ‘ভেক ও মুষিকের যুদ্ধ' রচিত হইয়াছিল এরূপ অনুমানও অসঙ্গত নহে। রঙ্গলালের অনুবাদে গোল্ডেস্মিথ কর্তৃক পার্ণেলের অনুবাদে লক্ষিত দোষ বর্তমান নাই।...."
বাংলা কাব্যে কৃতিত্ব :
রঙ্গলালের কাব্য উঁচুমানের না হলেও নানা কারণে তিনি বাংলা কাব্যে স্মরণীয় হয়ে আছেন। বাংলা কাব্যে তার অবদানগুলি হল:
(ক) বাংলা কাব্যে তিনি ঈশ্বরগুপ্তের উত্তরসূরি এবং মধুসূদনের পূর্বসূরি।
(খ) ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম স্বদেশচেতনামূলক আখ্যান কাব্য।
(গ) বাংলা কাব্যে দেশপ্রেমের উজ্জীবনে এবং দেশপ্রেমমূলক রোমান্স সৃষ্টিতে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।
(ঘ) সংস্কৃত, ইংরেজি, ওড়িয়া, ফারসি কবিতার অনুবাদেও তাঁর কৃতিত্ব ধরা পড়েছে।
(ঙ) কাব্যপ্রকরণে পুরাতন রীতি গ্রহণ করলেও বিদেশী কবিদের তিনি অনুসরণ করে পাশ্চাত্য ভাবধারাকে কাব্যে আনয়ন করেন।
(চ) সুকুমার সেন তাঁর কৃতিত্ব সম্বন্ধে লিখেছেন,
“বাঙ্গালীর সাহিত্য-ইতিহাসে রঙ্গলালের মূল্য শুধু নূতন কবিতার নান্দী-পাঠক রূপেই নহে। প্রথম সাহিত্য সমালোচক রূপেও তাহার অগ্রগামী কৃতিত্ব স্মরণীয়।”

No comments