Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

‘বৃত্তসংহার’ কাব্যের কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় :

মধুসূদনের উত্তরসূরি রূপে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে সমস্ত লেখক স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন , তাদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ‘বৃত্রসংহার' কাব্যের কবি...


মধুসূদনের উত্তরসূরি রূপে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যে সমস্ত লেখক স্মরণীয় হয়ে রয়েছেন , তাদের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য ‘বৃত্রসংহার' কাব্যের কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় । মূলত মধুসুদনের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ প্রকাশের পর তাঁর মহাকাব্য রচনার প্রতিভায় উদ্বুদ্ধ হয়ে হেমচন্দ্র মহাকবি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে বাংলা কাব্যজগতে অবতীর্ণ হন। হেমচন্দ্র বাংলা কাব্যে হিন্দু-সংস্কৃতির ভাব তথা জাতীয়তার বিকাশে সচেষ্ট হয়েছিলেন।

   পরিচয় :   
    ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে হুগলি জেলার রাজবল্লভঘাটে হেমচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। পিতা কৈলাশচন্দ্র সেকালের বিখ্যাত উকিল ছিলেন, তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি. এ. (১৮৫৯) পাশ করার পর ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে এল. এল. পাশ করে কলকাতা হাইকোর্টের মুন্সেফ হন। ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দে বি. এল পাশ করেন। ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে তিনি সরকারি উকিল হন। ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।

   রচনাবলী :   
   প্রথম রচনা :  
  • হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্য ‘চিন্তািতরঙ্গিনী’ (১৮৬১) ।

   কাব্যগ্রন্থ :    
  •  ‘চিন্তাতরঙ্গিনী' (১৮৬১), 
  • 'বীরবাহু কাব্য' (১৮৬৪), 
  • 'বৃত্র-সংহার কাব্য' (১-১১ সর্গ, ১৮৭৫,১২-২৪ সর্গ, ১৮৭৭), 
  • ‘আশাকানন’ (১৮৭৬), 
  • ‘ছায়াময়ী কাব্য’ (১৮৮০), 
  • ‘চিত্তবিকাশ’ (১৮৯৮), 
  • ‘দশ মহাবিদ্যা (১৮৮২) ।

   আলোচনা :   
   (১) ‘চিন্তাতরঙ্গিনী’ :   
  • কবির প্রতিবেশী বাল্যবন্ধু  শ্রীশচন্দ্র ঘোষের মৃত্যুতে ব্যাথিত হয়ে হেমচন্দ্র তাঁর প্রথম কাব্য ‘চিন্তািতরঙ্গিনী’ রচনা করেন ।
  • হেমচন্দ্রের প্রথম কাব্য ‘চিন্তাতরঙ্গিনী’ ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
  •  এই কাব্যে তিনি ঈশ্বরগুপ্ত ও রঙ্গলালের অনুসারী। 

   (২) ‘বীরবাহু কাব্য’ :   
  • হিন্দু জাতীয়তাবোধের পুনরুত্থানের যুগে দেশানুরাগবশত হেমচন্দ্র ‘বীরবাহু’ কাব্য রচনা করেন  ।
  • কাব্যটি ১৮৬৪ সালে প্রকাশিত হয় । 
  •  দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি প্রভৃতি জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে যুগাদর্শের প্রেরণায় হেমচন্দ্র ‘বীরবাহু’ কাব্য রচনা করেন। 
  • এটি মূলত স্বদেশপ্রেমের উজ্জীবনমূলক কাব্য। 
  • কাব্যের পরিচয় প্রসঙ্গে বিজ্ঞাপনে কবি লিখেছেন --
  • “উপাখ্যানটি আদ্যোপাত্ত কাল্পনিক, কোনো ইতিহাসমূলক নহে। পুরাকালে হিন্দুকুল তিলক বীরবৃন্দ স্বদেশ রক্ষার্থে কি প্রকার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন, কেবল চাহারই দৃষ্টাত্তস্বরূপ এই গল্পটি রচিত হইয়াছে।”

   (৩) ‘বৃত্তসংহার কাব্য’ :   
  • হেমচন্দ্রের শ্রেষ্ঠ কাব্য ‘বৃত্রসংহার' কাব্য।
  • এই কাব্য দু'খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছিল (প্রথম থেকে একাদশ সর্গ-১৮৭৫, দ্বাদশ থেকে পঞ্চবিংশ সর্গ-১৮৭৭)।
  • কবি স্বয়ং এই কাব্যকে মহাকাব্য অভিধায় অভিহিত করেন নি, শুধুমাত্র ‘কাব্য’ বলেছেন।
  • এই কাব্যের মূল বিষয়বস্তু পৌরাণিক হলেও এতে হেমচন্দ্রের মৌলিকতা যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে কিছুটা ইংরেজি কাব্যের অনুসরণ।
  • ‘বৃত্রসংহারে’র কাহিনির মধ্যে বিশালতা এই কাব্যের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। এমনকি রবীন্দ্রনাথও লিখেছিলেন --
“স্বর্গ উদ্ধারের জন্য নিজের অস্থিদান এবং অধর্মের ফলে বৃত্রের সর্বনাশ—যথার্থ মহাকাব্যের বিষয়।”

   (৪) ‘আশাকানন’ :   
  • ১৮৭৬ সালে 'আশাকানন'  কাব্যটি  প্রকাশিত হয়।
  • এটি একটি সাঙ্গরূপক কাব্য। 
  • এই কাব্যে মানবজাতির প্রকৃতিগত প্রবৃত্তিগুলির কথা বর্ণিত হয়েছে। 
  • এই রচনায় তেমন কোন বিশেষত্ব নেই।

  (৫) ‘ছায়াময়ী’ :   
  • ‘ছায়াময়ী’ কাব্য প্রকাশিত হয় ১৮৮০ সালে। 
  • কাব্যটি সাত পল্লবে বিভক্ত। 
  • দান্তের ‘ডিভাইন কমেডি'-র অনুসরণে রচিত। 
  • কাব্যটি ছয়টি পল্লব বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত। 
  • এখানে পাশ্চাত্য আদর্শে পাপ-পুণ্য, নরক-প্রায়শ্চিত্ত প্রভৃতি বর্ণিত হয়েছে। 
  • এই কাব্যের শিল্পমূল্য ক্ষীণ।
  (৬) ‘চিত্তবিকাশ :   
  • ‘চিত্তবিকাশ’ নীতিমূলক গীতিকবিতার সংকলন ।
  • কাব্যটি ১৮৯৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
  • বৃদ্ধ বয়সে কবি অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন, এই কাব্যে সেই খেদোক্তি বর্ণিত হয়েছে ।

  (৭) ‘দশমহাবিদ্যা’ :   
  • হেমচন্দ্রের ‘দশমহাবিদ্যা' কাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে। 
  • এই কাব্যের বিষয় হিন্দু পুরাণ ও তন্ত্রের দেবী-মাহাত্ম্য বিষয়ক পৌরাণিক ঘটনা। 
  • দেবীর দশটি প্রকৃতির মধ্যে দশটি বিভিন্ন স্তরের কল্পনারূপ পেয়েছে। 

   ‘বৃত্তসংহার’ মহাকাব্য কিনা ?   
        সুকুমার সেন সহ বিভিন্ন সাহিত্য সমালোচক ‘বৃত্তসংহার’ কাব্যকে মহাকাব্য আখ্যায় ভূষিত করতে চাননি। কারণ—
(ক) কাহিনির বিশালতা কাব্যে যথার্থ প্রতিফলিত হয়নি। 
(খ) বৃত্রের অপরাধ খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয় যাতে তাকে সংহারের জন্য বিশাল আয়োজন দরকার। 
(গ) পৌরাণিক বৃত্রাসুরের মহিমা হেমচন্দ্রের কাব্যে নেই। 
(ঘ) ঐন্দ্রিলার ভূমিকায় অসুরমহিষীর দৃপ্ত তেজ ফুটে নাই, ফুটিয়াছে রূপকথার সুয়োরাণীর হিংসা ও অভিমান।ঐন্দ্রিলা ছাড়া এই কাব্যের কোন চরিত্র জীবন্ত নয়। 
(ঙ) হেমচন্দ্রের অমিত্রাক্ষর ছন্দ আসলে মিলহীন পয়ার এবং তাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চার ছত্রের স্তবকে গড়া। 
(চ) উদারতা পরিস্ফুট হয়নি। 
(ছ) কাব্যের ভাষায়ও মধুসূদনের প্রভাব যথেষ্ট। কাব্যের অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজি কাব্যের ভাব সংকলিত হয়েছে।

  কাব্য সাহিত্যের ইতিহাসে হেমচন্দ্রের অবদান:   
        বাংলা কাবা সাহিত্যের ইতিহাসে হেমচন্দ্রের অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়।
১। সমকালে মধুসূদনের 'মেঘনাদবধ কাব্য' অপেক্ষা হেমচন্দ্রের 'বৃত্রসংহার কাব্য জনপ্রিয় হয়েছিল। তাঁর কাব্যে পরাধীনতার বেদনা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বিশেষভাবে অনুভূত হয়েছে। হেমচন্দ্র বাঙালির জাতীয় জীবনের কবি।
২। মধুসুদনের যথার্থ উত্তরসূরী ছিলেন হেমচন্দ্র।
৩। 'বৃত্রসংহার কাব্যে'র গুণগান করতে গিয়ে ড. শশিভূষণ দাশগুপ্ত বলেছেন, “সমগ্র কাব্যখানি যেন পাথরে ক্ষোদিত বিরাট মূর্তির ন্যায় স্পষ্ট ... ।”
৪। অধ্যাপক শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘বৃত্রসংহার'-এ 'মেঘনাদবধ'-এর তুলনায় গার্হস্থ্য প্রতিবেশ ও পরিবার জীবনের কোমল ভাবনিচয়ের প্রাধান্য
৫। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, 'স্বর্ণ উদ্ধারের জন্য নিজের অস্থিদান এবং অধর্মের ফলে বৃত্রের সর্বনাশ যথার্থ মহাকাব্যের বিষয়।

No comments