Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

‘দেহবাদী কবি’ মোহিতলাল মজুমদার :

বাংলা সাহিত্যের একজন নিপুণ ও শব্দ সচেতন কবি ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার। ভাবে ও ভাষায় প্রচলিত কাব্যরীতিতে তিনি ছিলেন বিদ্রোহীস্বরূপ। বাংলা সাহিত...


বাংলা সাহিত্যের একজন নিপুণ ও শব্দ সচেতন কবি ছিলেন মোহিতলাল মজুমদার। ভাবে ও ভাষায় প্রচলিত কাব্যরীতিতে তিনি ছিলেন বিদ্রোহীস্বরূপ। বাংলা সাহিত্যের দেহাত্মবাদী কবি হিসেবে তার রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। প্রথম জীবনে কবিতা লিখলেও পরবর্তী জীবনে সাহিত্য-সমালোচক হিসেবেই তিনি খ্যাতি লাভ করেন। গভীর অন্তর্দৃষ্টি, নিপুণ বিশ্লেষণ ও ভাবগম্ভীর ভাষার মহিমায় মোহিতলালের সমালোচনাধর্মী গ্রন্থগুলো ধ্রুপদী সাহিত্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে।

   পরিচয় :  
        ১৮৮৮ সালের ২৬ অক্টোবর নদীয়ার কাচঁড়াপাড়া গ্রামে মোহিতলাল মজুমদার জন্মগ্রহণ করেন। মোহিতলাল মজুমদারের পৈতৃক বাড়ি ছিল অধুনা পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার চুঁচুড়া মহকুমার অন্তর্গত বলাগড় গ্রামে। তার বাবার নাম নন্দলাল মজুমদার। মোহিতলালের কৈশোর এবং বিদ্যালয়জীবন বলাগড় গ্রামেই অতিবাহিত হয়। ছোটবেলায় তিনি কিছুদিন কাঁচড়াপাড়ার কাছে হালিশহরে মায়ের মামাবাড়িতে অবস্থান করে সেখানকার বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। মোহিতলাল চার-পাঁচ বছর বয়সে কাশীরাম দাসের মহাভারতের সঙ্গে পরিচিত হন। নয় বছর বয়সে তার রোমান্স পাঠে আগ্রহ জন্মায়। বারো-তেরো বছর বয়সে পলাশীর যুদ্ধ এবং মেঘনাদ বধ কাব্য পড়ে শেষ করেন। বলাগড় বিদ্যালয় থেকে ১৯০৪ সালে এন্ট্রান্স পাস করেন। ১৯০৮ সালে মেট্রোপলিটন ইন্সটিটিউশন থেকে বি.এ পাস করেন। কিন্তু অসুবিধায় পড়ে এম.এ পড়া ছেড়ে দেন। ক্যালকাটা হাইস্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করে ১৯২৮ পর্যন্ত তিনি এই পেশায়ই নিযুক্ত ছিলেন। মাঝে কিছুদিন (১৯১৪-১৭) সেটেলমেন্ট বিভাগে কানুনগো পদে কাজ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃত বিভাগে অধ্যাপনা কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪৪ সালে অধ্যাপনার চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন মোহিতলাল। তারপর তিনি কলকাতায় চলে যান। পরে বঙ্গবাসী কলেজে গিরিশ সংস্কৃতি ভবনে অধ্যাপনায় যোগ দেন এবং ১৯৪৪ সালে অবসরে যান। ২৬ জুলাই ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতায় মারা যান ।

    ছদ্মনাম :   
        সমালোচনামূলক প্রবন্ধগুলিতে  মোহিতলাল মজুমদার বেশ কয়েকটি ছদ্মনাম ব্যবহার করেন । ছদ্মনামগুলি হল :
  •  ‘প্রিয়দর্শী’, 
  • ‘সব্যসাচী’, 
  • ‘কৃত্তিবাস ওঝা’,
  • ‘শ্রী সত্যসুন্দর দাস’  
( এছাড়াও কবি মোহিতলাল  রবীন্দ্র বিরোধী, অঘোরপন্থি, ভোগবাদী বা দেহবাদী কবি হিসেবে বিশেষ পরিচিত)


     রচনাসমূহ :   
    প্রথম রচনা :   
  • তাঁর প্রথম কাব্য ‘দেবেন্দ্র-মঙ্গল’ (১৯২২) ছিল আত্মীয় ও কবি দেবেন্দ্রনাথ সেনের বিষয়ে প্রশস্তিমূলক ১৬টি সনেটের সংকলন। 
    শেষ রচনা :  
  • ‘ছন্দ চতুর্দশী’ (১৯৪১)। 

   কাব্যগ্রন্থ :   
        মোহিতলাল মজুমদারের কাব্যগ্রন্থগুলি হল যথাক্রমে --- 
  • ‘দেবেন্দ্ব-মঙ্গল’ (১৯২২), 
  • ‘স্বপন পসারী’ (১৯২২), 
  • ‘বিস্মরণী’ (১৯২৭), 
  • ‘স্মরগরল’ (১৯৩৬), 
  • ‘হেমন্ত-গোধূলি’ (১৯৪১), 
  • ‘ছন্দ চতুর্দশী’ (১৯৪১)। 

   সাহিত্য সমালোচনামূলক প্রবন্ধ :   
            মোহিতলাল মজুমদারের সমালোচনামূলক প্রবন্ধগ্রন্থগুলি হল :
  •  ‘আধুনিক বাংলা সাহিত্য’ (১৯৩৬), 
  • ‘সাহিত্যকথা’ (১৯৩৮), 
  • ‘বিবিধ কথা’ (১৯৪১), 
  • ‘বিচিত্র কথা’ (১৯৪১), 
  • ‘সাহিত্য বিভান’ (১৯৪২), 
  • ‘বাঙলা কবিতার ছন্দ’ (১৯৪৫), 
  • ‘বাঙলার নবযুগ’ (১৯৪৫), 
  • ‘জয়তু নেতাজী’ (১৯৪৬), 
  • ‘কবি শ্রীমধুসূদন’ (১৯৪৭), 
  • ‘সাহিত্য বিচার’ (১৯৪৭), 
  • ‘বঙ্কিমবরণ’ (১৯৪৯), 
  • ‘রবি প্রদক্ষিণ’ (১৯৪৯), 
  • ‘শ্রীকান্তের শরৎচন্দ্র’ (১৯৫০), 
  • ‘জীবন জিজ্ঞাসা’ (১৯৫১), 
  • ‘বাঙলা ও বাঙালী’ (১৯৫১), 
  • ‘কবি রবীন্দ্র ও রবীন্দ্র কাব্য’ (১ম খণ্ড ১৯৫২, ২য় খণ্ড ১৯৫৩), 
  • ‘বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস’ (১৯৫৫) ।

     রবীন্দ্রপর্বের কবি মোহিতলালের বিশিষ্টতার পরিচয় :   
            মোহিতলালের কাব্যে উপলব্ধির গভীরতা, ভাবের মৌলিকতা, স্খলনহীন রূপনির্মিতি সমকালীন কবিদের মধ্যে তাঁকে শ্রেষ্ঠত্ব দিয়েছে। রবীন্দ্র-অনুজ কবিগোষ্ঠীর মধ্যে তিনি যে প্রধান ব্যক্তিত্ব তাতে সন্দেহ নেই।

   মোহিতলালের কবিতার বৈশিষ্ট্য ও বিশিষ্টতার পরিচয় :   
        মোহিতলালের কবিতায় ভাবাবেগের অত্যন্ত প্রবলতা আছে, কিন্তু তা ঘনীভূত ; তারল্যে উচ্ছ্বসিত ও ফেনায়িত হয়ে ওঠেনি। আবেগের ঘনত্ব এবং আঙ্গিকের কাঠিন্য চমৎকার সমন্বয় লাভ করেছে। মোহিতলাল লঘুতাকে ভাবে বা ভাষায় কখনোই প্রশ্রয় দেননি। তাঁর কবিতা অতিমাত্রায় গম্ভীর এই অভিযোগ একেবারে অস্বীকার্য নয়। ভাষাপ্রয়োগে সংস্কৃতানুসরণ এই গাম্ভীর্য বাড়িয়েছে।

  মোহিতলালের কবিতার প্রেমভাবনার স্বরূপ :  
        মোহিতলালের প্রেমভাবনা দেহবাদী। কিন্তু দেহকে স্বীকার করেছেন কবি সুগভীর দার্শনিক চেতনার দিক দিয়ে। দার্শনিকতা মোহিতলালের কবিতার দুরূহতা এবং গাম্ভীর্য বাড়িয়েছে।


   মোহিতলালের রচিত সনেটের বৈশিষ্ট্য:   
        মোহিতলালের সনেট রচনার আগ্রহ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। সনেটের ঘনপিনদ্ধ আঙ্গিক কবির ক্লাসিক মনকে স্বাভাবিক আকর্ষণ করেছিল। এদের রুপসিদ্ধি যে দুর্লভ, তেমনি বুদ্ধিপ্রধান। অতরল ঘন আবেগের সংহত প্রকাশ হিসেবে এদের মূল্যও উচ্চমার্গের।

   রবীন্দ্রযুগের কবি মোহিতলালের রবীন্দ্র-বিরোধিতার পরিচয় :   
            ভাবকল্পনায়, বিশেষ করে প্রেমসম্পর্কের নবতাৎপর্য আবিষ্কারে মোহিতলাল রবীন্দ্রোত্তর আধুনিকতার দ্বারোদ্ঘাটনে এক অভিনব ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাঁর প্রাণদৃপ্ত দেহবাদী চেতনা রবীন্দ্র কল্পনার অশরীরী প্রেমানুভূতিকে অস্বীকার করল। তান্ত্রিক সাধকোচিত ইন্দ্রিয়লোকের সম্পূর্ণ ও নিঃসংশয়াতীত অঙ্গীকারে সন্ন্যাস ও ত্যাগের আদর্শ পরিত্যক্ত ও ধিকৃত হল। নার পাথর বাটি!

   বাংলা কাৰ্য্যসাহিত্যে মোহিতলাল মজুমদারের অবদান :    
            বাংলা কাব্যসাহিত্যে মোহিতলাল মজুমদারের বিশেষ অবদান আছে। 
(১)  সনেট রচনাতে তিনি যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন।
(২) মোহিতলাল বলেছেন, 'কাব্যের গৌরব আর যাহা হউক, যুদ্ধজয়ের মতো একটা কীর্তি নয়, সাম্রাজ্যসস্থাপন নয়, পরিতোদ্বার নয়।
(৩) দেহকেন্দ্রিক ভোগবাদের জয় ঘোষণা করে রবীন্দ্রকাবা বলয় থেকে বের হয়ে আসবার করেছেন মোহিতলাল
(৪) তাঁর অনেক কাব্যে বৈষ্ণব দর্শন ও শাক্ত দর্শনের সমন্বয় ঘটেছে।
(৫) রীতির দিক দিয়ে তিনি ক্ল্যাসিক ধর্মী।
(৬) মোহিতলালের কবিতার বলিষ্ঠ পৌরুষের প্রশংসা করে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন—
'‘পৌরুষের মধ্যে শক্তির আড়ম্বর নেই, শক্তির মর্যাদা আছে, সাহস আছে বাহাদুরি নেই।”

No comments