রাজশেখর বসু, যিনি বাংলাসাহিত্যে পরশুরাম নামেই সুপরিচিত, ছিলেন একাধারে একজন সাহিত্যিক ও কেমিস্ট। তাঁকে সকলে বিংশ শতাব্দীর একজন অগ্রগণ্য রসসাহ...

রাজশেখর বসু, যিনি বাংলাসাহিত্যে পরশুরাম নামেই সুপরিচিত, ছিলেন একাধারে একজন সাহিত্যিক ও কেমিস্ট। তাঁকে সকলে বিংশ শতাব্দীর একজন অগ্রগণ্য রসসাহিত্যিক হিসাবেই চেনে। তিনি ছদ্মনামের অন্তরালে থেকে বাংলা গল্পভাণ্ডের একটি দৈনাকে অনেকাংশে দূর করেছেন।
পরিচিতিঃ
রাজশেখর বসু পূর্ববর্ধমান জেলার বাসুল পাড়া গ্রামে ১৮৮০ সালের ১৬ই মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন চন্দ্রশেখর বসু ও লক্ষ্মীমণী দেবীর দ্বিতীয় পুত্র। তাঁর শৈশব কেটেছিল বিহারের দ্বারভাঙ্গায়। হিন্দীই ছিল তাঁর প্রথম ভাষা। ছোটবেলা থেকেই তিনি বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ অনুভব করতেন। এক সময় তাঁর সঙ্গে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়। আচার্য এই সময় বেঙ্গল কেমিক্যাল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০৬ সালে রাজশেখর তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে কেমিস্ট হিসাবে সেখানে যোগদান করেন। পরে তিনি ম্যানেজার পদে উন্নীত হন। এই ভাবে বহু বছর বেঙ্গল কেমিক্যালের কর্ণধার হয়ে থেকে এবং 'লালিমা পাল (পুং) বা কারিয়া পীরেৎ এর মত বহু চরিত্র সৃষ্টি করে বাঙ্গালীকে হাস্যরসে ডুবিয়ে রেখে পরশুরাম ১৯৬০ সালের ২রা এপ্রিল ৮০ বছর বয়সে রাজ শেখর অমর ধামে চলে গেলেন।
ছদ্মনাম প্রসঙ্গঃ
বাংলা সাহিত্যে তিনি তাঁর ছদ্মনাম -- ‘পরশুরাম’ হিসাবেই সুপরিচিত ছিলেন। এই পরশুরাম কিন্তু মহাভারতের পরশুরাম নন। ছদ্মনাম গ্রহন প্রসঙ্গে তিনি লিখছেন ---
"ভাবছিলাম ছদ্মনামে লিখব। একদিন সকালবেলা গভীর ভাবে ভাবছিলাম কি নাম নিই? এমন সময় আমাদের বাড়ির সেকরা তারাচরণ পরশুরাম এসে হাজির। তখনই ঠিক করলাম এই হবে আমার ছদ্মনাম।"
প্রথম রচনাঃ
⇛ রাজশেখর বসুর প্রথম গল্প ‘শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড’ (১৯২২) -- ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
⇛ তাঁর প্রথম বই 'গড্ডালিকা' ১৯২৪ সালে প্রকাশিত হয়।
⇛ ১৯৩৭ সালে তাঁর লেখা অভিধান 'চলন্তিকা' প্রকাশ পায়।
গ্রন্থসমুহ :
অভিধান : ‘চলন্তিকা’ (১৯৩৭)
গল্পগ্রন্থ :
১) ‘গড্ডালিকা’ (১৯২৪)
২) ‘কজ্জলী’ (১৯২৭)
৩) ‘হনুমানের স্বপ্ন’ (১৯৩৭)
৪) ‘নীলতারা’ (১৯৫০)
৫) ধুস্তুরীমায়া’ (১৯৫২)
৬) ‘কৃষ্ণকলি’ (১৯৫৩)
৭) ‘আনন্দীবাঈ’ (১৯৫৭)
৮) ‘চমৎকুমারী’
অনুবাদ :
১) ‘কালিদাসের মেঘদুত’ (১৯৫৩)
২) ‘বাল্মিকীর রামায়ণ’ (১৯৪৬)
৩) ‘ব্যাসের মহাভারত (১৯৫০)
৪) ‘শ্রীমদ্ভাগবত গীতা।
প্রবন্ধ গ্রন্থ :
১) ‘লঘু গুরু’ (১৯৩৯)
২) ‘ভারতের খনিজ’
৩) ‘কুটীর শিল্প’
৪) ‘বিচিন্তা’ (১৯৫৫)
পুরষ্কার ও সম্মাননা :
রাজশেখর তাঁর সাহিত্যকীর্তির জন্য অনেক পুরস্কার পেয়েছিলেন।
⇛ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর সাহিত্যকীর্তির জন্য তাঁকে 'জগত্তারিণী পদক' (১৯৪৫) ও সরোজিনী পদকে ভূষিত করেন।
⇛ ১৯৫৭ সালে তাঁকে সান্মানীক 'ডি লিট' পুরস্কার দেন।
⇛ পরের বছর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ও তাঁকে 'ডি লিট' সন্মান দেন।
⇛ তাঁর 'কৃষ্ণকলি ইত্যাদি গল্প', ১৯৫৫ সালে রবীন্দ্র পুরস্কার পায়।
⇛ ১৯৫৬ সালে ভারত সরকার তাঁকে 'পদ্মভূষণ', উপাধিতে ভূষিত করেন।
⇛ ১৯৫৮ সালে তিনি 'আনন্দীবাঈ ইত্যাদি গল্পের' জন্য এ্যাকাডেমী পুরস্কার পান।
পরশুরামের জনপ্রিয়তার কারণ :
চরিত্রের আচার-ব্যবহার, সংলাপ, পরিবেশ প্রভৃতি কৌতুককর সন্নিবেশে তাঁর গল্পগুলি শুরু রসিকতাপ্রিয় পাঠের সাময়িক চিত্তবিনোদন করেই মুছে যায়নি। অসাধারণ অভিজ্ঞতা, কৌতু সৃষ্টির দুর্লভ শক্তি, বুদ্ধির উজ্জ্বলতা কোথাও কোথাও অসামান্য ব্যঙ্গরস পরিবেশনে গল্পসংগ্রহগুলি রুচিমান পাঠকসমাজে এখনও অত্যন্ত আকর্ষণের বস্তু হয়ে আছে।
বাংলা ছোটো গল্পে রাজশেখর বসুর অবদান :
রাজশেখর বসু ওরফে 'পরশুরাম' ছদ্মনামের অন্তরালে থেকে বাংলা গল্পভাণ্ডের একটি দৈনাকে অনেকাংশে দূর করেছেন। আমাদের সাহিত্যে হাস্যরসপ্রধান ব্যঙ্গকৌতুকের পরিমাণ কম, যদিও জীবনে হাসিরঙ্গ ও ব্যঙ্গের উপাদান যথেষ্ট আছে। নিজ জীবনের চলতিকাল ও দৈনন্দিন সংসারের শত-সহস্র অসঙ্গতিকে উদ্ঘাটন করে, নিরাসক্ত দৃষ্টিতে জীবনের অন্তঃসারশূন্যতা আতিশয্যগুলিকে লোকসমক্ষে তুলে ধরাই পরশুরামের উদ্দেশ্য। বুদ্ধিদীপ্ত রসিকতাই তাঁর গল্পের বৈশিষ্ট্য। তিনি ঠিক ‘হিউমারিস্ট' নন, শ্লেষ বৈদগ্ধ্যই তাঁর গল্পের শোভা।
No comments