শুধুমাত্র মঙ্গলকাব্যের ধারায় নয়, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী । মঙ্গলকাব্যের পুচ্ছগ্রা...
শুধুমাত্র মঙ্গলকাব্যের ধারায় নয়, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী । মঙ্গলকাব্যের পুচ্ছগ্রাহিতার পথ পরিত্যাগ করে জীবনরসিক কবি মুকুন্দ স্বকীয় মৌলিকতা ও সৃজনশীলতার জন্য বাংলা সাহিত্যে চিরস্থায়ী আসন করে নিতে পেরেছেন । মানবতাবাদী কবি মুকন্দ কাহিনীগ্রন্থনে, চরিত্রচিত্রণে, রচনারীতিতে, জীবন সম্বন্ধে প্রসন্ন ভাবগম্ভীর অথচ বাস্তবনিষ্ঠ ও নাটকীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্ময়কর কৃতিত্বের জয়টীকা পরে বাংলা সাহিত্যের পাঠক সমাজের হৃদয়ের মণিকোঠায় সসম্মানে প্রতিষ্ঠিত থাকবেন।
আত্মপরিচয় :
মধ্যযুগের মঙ্গলকাব্যের কবিদের আত্মপরিচয় থেকে তাদের ব্যক্তিপরিচয় ও কাব্য রচনার কাল নির্ধারণ করা হয় - যদিও তা সবক্ষেত্রে সহজসাধ্য নয়। মুকুন্দের আত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রেও সেই একই কথা প্রযোজ্য। ধারণা করা হয় তার জন্ম ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুকুন্দ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পিতা হৃদয় মিশ্র এবং মাতা দৈবকী |
ডিহিদার মামুদ শরিফের অত্যচারে উৎখাত হয়ে আনুমানিক ১৫৫৭ খ্রিষ্ট্রাব্দে মুকুুন্দরাম পৈতৃক নিবাস ত্যাগ করে মেদিনীপুর জেলার আড়রা গ্রামে আশ্রয় নেন,সেখানে গ্রাম্য জমিদার বাঁঁকুড়া রায়ের দ্বারস্থ হন।
কাব্য পরিচয় :
মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্যের নাম ‘অভয়ামঙ্গল’ । যদিও তা ‘চন্ডিমঙ্গল’ নামেও পরিচিত ।‘অভয়ামঙ্গল’ ছাড়া কবি কাব্যকে ‘অম্বিকামঙ্গল’ , ‘গৌরিমঙ্গল’ নামে পরিচিতি দিয়েছেন ।কবির কাব্যের দুটি খন্ডঃ (a) আখেটিক খন্ড (b) বণিক খন্ড ।আখেটিক খন্ডের চরিত্র - ধর্মকেতু, কালকেতু, ফুল্লরা, মুরারীশীল, ভাঁড়ুদত্ত । বণিক খন্ডের চরিত্র - কলিঙ্গরাজ, ধনপতি, শ্রীমন্ত , খুল্লনা ।
কাব্য রচনাকাল :
১৭৪৫ শকে (১৮২৩-২৪ খ্রিঃ) রামজয় বিদ্যাসাগরের সম্পাদনায় কবি মুকুন্দের চণ্ডীমঙ্গল সর্বপ্রথম মুদ্রিত হয়। এই গ্রন্থের শেষে কালজ্ঞাপক কয়েক ছত্র মুদ্রিত হয়ঃ
‘‘শাকে রস রস বেদ শশাঙ্ক গণিতাকতদিনে দিলা গীত হরের বনিতা।”
রস শব্দকে ছয় ধরলে এই শ্লোকের অর্থ দাঁড়ায়– রস = ৬, বেদ = ৪, শশাঙ্ক = ১, অর্থাৎ ৬৬৪১ (অঙ্কস্য বামা গতি) = ১৪৬৬ শকাব্দ বা ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দ (১৪৬৬ শক + ৭৮ = ১৫৪৪ খ্রিস্টাব্দ)। আবার রসকে নয় ধরলে দাঁড়ায় ৯৯৪১ (১৪৯৯শকাব্দ) অর্থাৎ ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে চণ্ডীমঙ্গল রচনার কাল।
মুকুন্দ চক্রবর্তীর ধর্মমতঃ
কবি মুকুন্দের ধর্মমত বিষয়ে সমালোচক মহলে মতভেদ যথেষ্ট। আর এই মতভেদের কারণ তিনি চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের রচয়িতা হলেও এবং তার বাড়ীতে মহিষমর্দিনী প্রতিমা ছিল যাঁর চার হাতে শঙ্খ চক্র গদা পদ্ম সহ গলায় বনমালা ছিল। মুকুন্দের পিতামহ জগন্নাথ বহুকাল মাছ মাংস ত্যাগ করে দশাক্ষর গোপাল মন্ত্র জপসহ গোপাল পূজা করতেন।
উপাধিঃ
মুকুন্দ চক্রবর্তীর উপাধি ছিল ‘কবিকঙ্কন’ । ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্য রচনা করার জন্য রঘুনাথ রায় এই উপাধি দেন ।
চরিত্র পরিচয়ঃ
(১) কালকেতু --- নীলাম্বর ।
(২) ফুল্লরা --- নীলাম্বর পত্নী ছায়া ।
(৩) খুল্লনা --- স্বর্গেরর নর্তকী রত্নমালা ।
(৪) শ্রীমন্ত --- মালাধর।
আধুনিক উপন্যাসের লক্ষণঃ
মুকুন্দের মধ্যে দক্ষ ঔপন্যাসিকের অধিকাংশ গুণই ছিল ।‘এ যুগে জন্মগ্রহণ করিলে তিনি যে কবি না হইয়া একজন ঔপন্যাসিক হইতেন, এই বিষয়ে সন্দেহ নাই' -- একথা ডঃ শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তার 'বঙ্গসাহিত্যের উপন্যাসের ধারা’ গ্রন্থে বলেছেন কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম সম্পর্কে। একথার কারণ হিসাবে বলা যায়ঃ
ক) বাস্তবতা, অভিজ্ঞতা, সহানুভূতি, চরিত্র বিশ্লেষণের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রয়েছে ।
খ) নারী মনস্তত্ত্ব, পরিহাস রসিকতা সুন্দরভাবে চিত্রিত হয়েছে ।
গ) সামাজিক মানুষের সংঘাত বিক্ষুদ্ধ জীবনের বাস্তব কাহিনি রূপায়ণে মুকুন্দরাম যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্রমণ্ডিত চরিত্রগুলি তুলে ধরেছেন—তাতেই তাঁর কবিপ্রতিভা ঔপন্যাসিকের সমধর্মী হয়ে আধুনিক চেতনার স্বগোত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঘ) মুকুন্দরাম কেবল সময়ের অভাব অতিক্রম করতে, অতীত প্রদর সঙ্গে নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করতে, অলৌকিকতার হাত থেকে সম্পূর্ণ মুক্তিলাভ করতে পারেননি বলেই একজন খাঁটি ঔপন্যাসিক হতে পারেননি। দক্ষ ঔপন্যাসিকের অধিকাংশ খুই তাঁর মধ্যে বর্তমান ছিল।
দুঃখবাদী কবি কিনা ?
না, মুকুন্দরাম দুঃখবাদী কবি নন। মঙ্গলকাব্যকার হয়েও তিনি মানবতাবাদী কবি, মঙ্গলকাব্যের তিনি লোককাপ্ত কবি। মর্ত্যমানবের সুখদুঃখের চিত্র তাঁর কাব্যে জীবন্ত ব্যক্তি স্বাতন্ত্রোর আরোপ ও জীবন রসের প্রাচুর্যে মুকুন্দ মধ্যযুগের মাটিতে পাঁড়িয়েও আধুনিক মানবধর্মের প্রবন্ধ।
কাহিনী নির্মাণঃ
চণ্ডীমঙ্গলের গতানুগতিক কাহিনিকে নবতর রূপদান করেছেন মুকুন্দরাম। তাঁর কৃতিত্ব মানুষের কাহিনিতে বৈচিত্র্য সম্পাদনের মধ্যে। তৎকালীন সমাজের প্রতি বাস্তব দৃষ্টি অসীম কৌতূহল ও শ্রদ্ধা সহকারে দারিদ্র্যলাঞ্ছিত জীবনযাত্রার নিখুঁত ছবি তিনি এঁকেছেন। বাস্তববোধ ও জীবনবোধের ভাবগত সমন্বয়ে তাঁর রচনা রসোত্তীর্ণ হয়েছে।
‘মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল একটি চরিত্র চিত্রশালা’
আধুনিক সাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য—চরিত্র সৃষ্টি। মুকুন্দরাম চরিত্র সৃষ্টিতে সূক্ষ্ম-দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়ে, বাস্তবরসের সংযোজন ঘটিয়ে এ ব্যাপারে আশ্চর্য সাফল্য অর্জন করেছেন। কালকেতুর ব্যাধসুলভ Rustic | ব্যাধপত্নী ফুল্লরার যথার্থ পতিভক্তিপরায়ণতা, বাকচাতুর্যে অনন্যা। ভাঁড়ু দত্ত ও মুরারি শীলের শঠতা মুকুন্দের কৃতিত্ব। দক্ষ ভাস্কর্যশিল্পীর মতো তিনি মানবচরিত্রের বিভিন্ন দিক উদ্ঘাটিত করেছেন।
ভাষা ও রচনারীতিঃ
মুকুন্দরাম ভাষা ও রচনারীতি পূর্বের কবিদের থেকে অনেক মার্জিত ও অলংকার সমৃদ্ধ। ভার ও শব্দার্থের মধ্যে নৈকট্য স্থাপনে, বর্ণনার প্রাক্কলতা, উপমা ও চিত্রকল্প ব্যবহারে, লৌকিক হবে সৃষ্টিতে তিনি যথেষ্ট শিল্পনৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন।
মঙ্গলকাব্যধারায় মুকুন্দরামের প্রভাবঃ
মঙ্গলকাব্যধারায় মুকুন্দরামের প্রভাব বিপরীতমুখী হয়েছে। মুকুন্দরামের সমুচ্চ সাফল্যের পরে চণ্ডীমঙ্গল লিখে কবিখ্যাতি দুরূহ মনে করে অনেকেই এদিকে অগ্রসর হননি। অপরদিকে পরবর্তী শক্তিশালী কবি ভারতচন্দ্রও মুকুন্দরামের অনুসরণে স্বতন্ত্র কাহিনিকাব্য লিখেছেন। মুকুন্দুরামের পরের যুগের মঙ্গলকাব্যের অনেক কবি তাঁর আদর্শে আত্মজীবনী লিখেছেন ।
এক নজরে মুকুন্দ চক্রবর্তী |
2. মুকুন্দ চক্রবর্তীর আদি নিবাস ছিল বর্ধমান জেলার দামুন্যা গ্রাম ।
3. মুকুন্দ চক্রবর্তীর পিতার নাম হৃদয় মিশ্র, মাতার নাম দৈবকী । পিতামহ জগন্নাথ মিশ্র ।
4. কবির পিতার উপাধি ছিল ‘কবিকঙ্কন’ ।
5. মুকুন্দের দুই পুত্র শিবরাম ও সনাতন । দুই কন্যা বিমলা ও যশোদা । জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কবিচন্দ্র । কনিষ্ঠ ভ্রাতা রামনাথ ।
6. মুকুন্দ চক্রবর্তীর কাব্যের নাম ‘অভয়ামঙ্গল’ ।
7. মুকুন্দ চক্রবর্তী তাঁর কাব্যকে ‘নৌতন মঙ্গল’ বলেছেন ।
8. মুকুন্দ চক্রবর্তী তার কাব্য রচনা করেন পঞ্চদশ শতকের সূচনায়।
9. কাব্য রচনা করতে ৯ বছর সময় লাগে ।
10. কবি মুকুন্দরাম জমিদার রঘুনাথ রায়ের সভাসদ ছিলেন ।
11. বাঁকুড়া রায়ের পুত্র ছাত্র রঘুনাথ রায়ের নির্দেশে কবি কাব্য রচনা শুরু করেন ।
12. জমিদার রঘুনাথ রায় কবিকে ‘কবিকঙ্কন’ উপাধি প্রদান করেন চন্ডীমঙ্গল কাব্য রচনা করার জন্য ।
13.ডিহিদার মামুদ শরিফের অত্যাচারে কবি স্বগ্রাম থেকে উৎখাত হয়ে মেদিনীপুরের আরড়া গ্রামে জমিদার বাকুড়া রায়ের আশ্রয় গ্রহন করেন ।
14. মুকুন্দ চক্রবর্তী রঘুনাথ দাসের পৃষ্ঠপোষকতায় ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্য রচনা করেন ।
15. ‘অভয়ামঙ্গল’ ছাড়া কবি কাব্যকে ‘অম্বিকামঙ্গল’ , ‘গৌরিমঙ্গল’ নামে পরিচিতি দিয়েছেন ।
16.‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্যের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ আছে, কারো মতে --১৫৪৪ - ৪৫, আবার কারো মতে-- ১৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দ ।
17. কাব্য রচনাকাল জ্ঞাপক শ্লোকটি হলঃ ‘শাকে রস রস বেদ শশাঙ্ক গনিতা ।
কত দিনে দিলা গীত হরের বনিতা ।”
18. এই শ্লোকটি বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়ঃ রস = ৯, বেদ = ৪, শশাঙ্ক = ১, শাকে = শকাব্দ ।
অর্থাৎ ১৪৯৯ শকাব্দ বা (১৪৯৯+৭৮) = ১৫৭৭ খ্রিষ্টাব্দ ।
19. ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্য রচনা ১৬১২ খ্রিষ্টাব্দে শেষ হয় ।
20. ‘অভয়ামঙ্গল’ কাব্য ১৮২৩ - ২৪ খ্রিষ্টাব্দে রামজয় বিদ্যাসাগরের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ।
21. কবির কাব্যের দুটি খন্ডঃ (১) আখেটিক খন্ড (২) বণিক খন্ড ।
22. আখেটিক খন্ডের চরিত্র - ধর্মকেতু, কালকেতু, ফুল্লরা, মুরারীশীল, ভাঁড়ু দত্ত ।
23. বণিক খন্ডের চরিত্র - কলিঙ্গরাজ, ধনপতি, শ্রীমন্ত , খুল্লনা ।
24. মুকুন্দরাম দুঃখবাদী কবি নামে পরিচিত ।
25.‘এ যুগে জন্মগ্রহন করিলে মুকুন্দরাম একজন স্বার্থক ঔপন্যাসিক হইতেন’ - একথা বলেন শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর ‘বঙ্গ সাহিত্যে উপন্যাসের ধারা’ গ্রন্থে ।

No comments