বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটোগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মূলত হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতে ত...
বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটোগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। মূলত হিতবাদী, সাধনা, ভারতী, সবুজ পত্র প্রভৃতি মাসিক পত্রিকাগুলির চাহিদা মেটাতে তিনি তাঁর ছোটগল্প রচনা করেছিলেন। এসব রচনা উচ্চ সাহিত্যমূল্য-সম্পন্ন। রবীন্দ্রনাথের জীবনের ‘সাধনা’ পর্বটি (১৮৯১–৯৫) ছিল সর্বাপেক্ষা সৃষ্টিশীল পর্যায়। তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গল্পসংকলনের প্রথম তিন খণ্ডের চুরাশিটি গল্পের অর্ধেকই রচিত হয় এই সময়কালের মধ্যে। এসব গল্পে পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির প্রতি রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন ঘটেছে। আধুনিক ধ্যানধারণা সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেছেন তিনি।
আলোচনা :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট ১১৯টি ছোটোগল্প লিখেছেন। গল্পগুচ্ছের তিনখণ্ডে গল্প আছে ৮৪টি। ১৩৬৯ বঙ্গাব্দে বিশ্বভারতী তিনসঙ্গীর তিনটি ছোটোগল্প এবং শেষপর্বের চারটি গল্প নিয়ে গল্পগুচ্ছ চতুর্থ খণ্ড প্রকাশ করে। এই খণ্ডে রবীন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের লেখা 'ভিখারিণী' এবং 'করুণা' ও 'মুকুট' স্থান পায়। গল্পগুচ্ছের গল্পের সংখ্যা দাঁড়ায় ৯৪টি। এরমধ্যে অর্ধেকেরও বেশি গল্প লিখেছেন শিলাইদহে। এছাড়া সাজাদপুর, কলকাতা, শান্তিনিকেতন, চেন্নাই প্রভৃতি স্থানেও কিছু গল্প লিখেছেন। তবে সব গল্পই প্রায় প্রকাশিত হয়েছে সাময়িক পত্রিকায়।
রবীন্দ্রনাথের গল্পগুলিকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করা যেতে পারে।
(১) ১৮৯১ থেকে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত হিতবাদী ও সাধনা পত্রিকার যুগ,
(২) ১৯১৪ থেকে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতী ও সবুজপত্র পত্রিকার যুগ,
(৩) ১৯৩০ থেকে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ‘তিনসঙ্গী'র যুগ।
প্রথম পর্বের গল্পে জীবনের বিচিত্র অনুভূতি, রোমান্টিকতা নিসর্গপ্রীতি প্রাধান্য পেয়েছে। দ্বিতীয় পর্বের গল্পগুলিতে যুক্তি, মনন, নারীর অধিকার ও বুদ্ধিবাদ প্রাধান্য পেয়েছে। তৃতীয় পর্বের গল্পগুলিতে মনন অনুভূতি প্রাধান্য লাভ করেছে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটোগল্প সংখ্যা :
রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছের তিনখণ্ডে ৮৪টি ছোটোগল্প স্থান পেয়েছে। ‘সে’ গ্রন্থে আছে ১৪টি গল্প, ‘গল্পসল্পে’ আছে ১৬টি গল্প, ‘তিনসঙ্গী'তে আছে ৩টি গল্প। এছাড়া ‘মুকুট’, ‘ভিখারিণী' নামে ২টি গল্প লেখেন। এই হিসাবে রবীন্দ্রনাথের মোট ছোটোগল্পের সংখ্যা ১১৯টি।
ছোটোগল্প লেখার প্রেরণা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের অভিমত :
ছোটোগল্প লেখার প্রেরণা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন,
“শিলাইদহে পদ্মার বোটে ছিলাম আমি একলা। ....বোট ভাসিয়ে চলে যেতুম পদ্মার থেকে পাবনার কোলের ইছামতিতে, ইছামতি থেকে বড়াল হুড়ো সাগরে, চলন বিলে, আনাইয়ে, নাগর নদীতে, যমুনা পেরিয়ে সাজাদপুরের খাল বেয়ে সোজাদপুরে.... আমার গল্পগুচ্ছের ফসল ফলেছে আমার গ্রাম থেকে গ্রামান্তরের পথে ফেরা এই অভিজ্ঞতার ভূমিকায়।”
প্রথম গল্প :
(a) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রথম গল্প ‘ভিখারিণী’, ১৮৭৪ সালে ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
(b) প্রথম সার্থক ছোটগল্প ‘দেনা-পাওনা’ (১৮৯০) ।
শেষ গল্প :
(a) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা শেষ গল্প - ‘মুসলমানীর গল্প’ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ।
(b) রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে প্রকাশিত শেষ গল্প -‘বদনাম’ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ।
(c) রবীন্দ্রনাথের প্রকাশিত শেষ গল্প -- ‘প্রগতি সংহার’ (১৩৪৮ বঙ্গাব্দ) ।
গল্পের নাম -- পত্রিকা ও প্রকাশকাল:
সাময়িক পত্রিকায় প্রকাশিত গল্পগুলি কালানুক্রমে সাজানো হল—
- ‘ভিখারিণী’ ⇒ ‘ভারতী’, শ্রাবণ-ভাদ্র ১২৮৪
- ‘ঘাটের কথা’ ⇒ ‘ভারতী’, কার্তিক ১২৯১
- ‘রাজপথের কথা’ ⇒ ‘নবজীবন’, অগ্রহায়ন ১২৯১
- ‘মুকুট’ ⇒ ‘ বালক’, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ১২৯২
- ‘দেনাপাওনা’ ⇒ ‘হিতবাদী’, ১২৯৮
- ‘পোস্টমাস্টার’ ⇒ ‘হিতবাদী’, ১২৯৮
- ‘গিন্নি’ ⇒ ‘হিতবাদী’, ১২৯৮
- ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’ ⇒ ‘হিতবাদী’, ১২৯৮
- ‘ব্যবধান’ ⇒ ‘হিতবাদী’, ১২৯৮
- ‘তারাপ্রসন্নের কীর্তি’ ⇒ ‘হিতবাদী’, ১২৯৮
- ‘খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন’ ⇒ ‘সাধনা’, অগ্রহায়ন ১২৯৮
- ‘সম্পত্তি সমর্পণ’ ⇒ ‘সাধনা’, পৌষ ১২৯৮
- ‘দালিয়া’ ⇒ ‘সাধনা’, মাঘ ১২৯৮
- ‘কঙ্কাল’ ⇒ ‘সাধনা’, ফাল্গুন ১২৯৮
- ‘মুক্তির উপায়’ ⇒ ‘সাধনা’, চৈত্র ১২৯৮
- ‘ত্যাগ’ ⇒ ‘সাধনা’, বৈশাখ ১২৯৯
- ‘একরাত্রি’ ⇒ ‘সাধনা’, জ্যৈষ্ঠ ১২৯৯
- ‘একটা আষাঢ়ে গল্প’ ⇒ ‘সাধনা’, আষাঢ় ১২৯৯
- ‘জীবিত ও মৃত’ ⇒ ‘সাধনা’, শ্রাবণ ১২৯৯
- ‘স্বর্ণমৃগ’ ⇒ ‘সাধনা’, ভ্রাদ্র - আশ্বিন ১২৯৯
- ‘রীতিমতো নভেল’ ⇒ ‘সাধনা’, ভাদ্র - আশ্বিন ১২৯৯
- ‘জয় পরাজয়’ ⇒ ‘সাধনা’, কার্তিক ১২৯৯
- ‘কাবুলিওয়ালা’ ⇒ ‘সাধনা’, অগ্রহায়ন ১২৯৯
- ‘ছুটি’ ⇒ ‘সাধনা’, পৌষ ১২৯৯
- ‘সুভা’ ⇒ ‘সাধনা’, মাঘ ১২৯৯
- ‘মহামায়া’ ⇒ ‘সাধনা’, ফাল্গুন ১২৯৯
- ‘দান প্রতিদান’ ⇒ ‘সাধনা’, চৈত্র ১২৯৯
- ‘সম্পাদক’ ⇒ ‘সাধনা’, বৈশাখ ১৩০০
- ‘মধ্যবর্তিনী’ ⇒ ‘সাধনা’, জ্যৈষ্ঠ ১৩০০
- ‘অসম্ভব কথা’ ⇒ ‘সাধনা’, আষাঢ় ১৩০০
- ‘শাস্তি’ ⇒ ‘সাধনা’, শ্রাবণ ১৩০০
- ‘একটি ক্ষুদ্র পুরাতন গল্প’ ⇒ ‘সাধনা’, ভাদ্র ১৩০০
- ‘সমাপ্তি’ ⇒ ‘সাধনা’, আশ্বিন - কার্তিক ১৩০০
- ‘সমস্যাপূরণ’ ⇒ ‘সাধনা’, অগ্রহায়ন ১৩০০
- ‘খাতা’ ⇒ (গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত) ।
- ‘অনধিকার প্রবেশ’ ⇒ ‘সাধনা’, শ্রাবন ১৩০১
- ‘মেঘ ও রৌদ্র’ ⇒ ‘সাধনা’, আশ্বন - কার্তিক ১৩০১
- ‘প্রায়শ্চিত্ত’ ⇒ ‘সাধনা’, অগ্রহায়ন ১৩০১
- ‘বিচারক’ ⇒ ‘সাধনা’, পৌষ ১৩০১
- ‘নিশীথে’ ⇒ ‘সাধনা’, মাঘ ১৩০১
- ‘আপদ’ ⇒ ‘সাধনা’, ফাল্গুন ১৩০১
- ‘দিদি’ ⇒ ‘সাধনা’, চৈত্র ১৩০১
- ‘মানভঞ্জন’ ⇒ ‘সাধনা’, বৈশাখ ১৩০২
- ‘ঠাকুরদা ‘ ⇒ ‘সাধনা’, জ্যৈষ্ঠ ১৩০২
- প্রতিহিংসা’ ⇒ ‘সাধনা’, আষাঢ় ১৩০২
- ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ ⇒ ‘সাধনা’, শ্রাবণ ১৩০২
- ‘অতিথি’ ⇒ ‘সাধনা’, ভাদ্র - কার্তিক ১৩০২
- ‘ইচ্ছাপূরণ’ ⇒ ‘সাধনা’, ভাদ্র - কার্তিক ১৩০২
- ‘দুরাশা’ ⇒ ‘ভারতী‘, বৈশাখ ১৩০৫
- ‘পুত্রযজ্ঞ’ ⇒ ‘ভারতী‘, জ্যৈষ্ঠ ১৩০৫
- ‘ডিটেকটিভ’ ⇒ ‘ভারতী‘, আষাঢ় ১৩০৫
- ‘অধ্যাপক’ ⇒ ‘ভারতী‘, ভাদ্র ১৩০৫
- ‘রাজটিকা’ ⇒ ‘ভারতী‘, আশ্বিন ১৩০৫
- ‘মণিহারা’ ⇒ ‘ভারতী’, অগ্রহায়ন ১৩০৫
- ‘দৃষ্টিদান’ ⇒ ‘ভারতী’, পৌষ ১৩০৫
- ‘সদর ও অন্দর’ ⇒ ‘প্রদীপ’, আষাঢ় ১৩০৭
- ‘উদ্ধার’ ⇒ ‘ভারতী’, শ্রাবণ ১৩০৭
- ‘দুর্বুদ্ধি’ ⇒ ‘ভারতী’, ভাদ্র ১৩০৭
- ‘ফেল’ ⇒ ‘ভারতী’, আশ্বিন ১৩০৭
- ‘শুভদৃষ্টি’ ⇒ ‘প্রদীপ’ আশ্বিন ১৩০৭
- ‘যজ্ঞেশ্বরের যজ্ঞ’ ⇒ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ১৩০৭
- ‘উলুখড়ের বিপদ’ ⇒ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ১৩০৭
- ‘প্রতিবেশিনী’ ⇒ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত ১৩০৭
- ‘নষ্টনীড়’ ⇒ ভারতী’, বৈশাখ - অগ্রহায়ন ১৩০৮
- ‘দর্পহরণ’ ⇒ ‘বঙ্গদর্শন’ ফাল্গুন ১৩০৯
- ‘মাল্যদান’ ⇒ ‘বঙ্গদর্শন’ চৈত্র, ১৩০৯
- ‘কর্মফল’ ⇒ কুন্তলীন পুরষ্কারের জন্য , ১৩১০
- ‘মাস্টার মশাই’ ⇒ ‘প্রবাসী’ , আষাঢ় - শ্রাবণ, ১৩১৪
- ‘গুপ্তধন’ ⇒ ‘বঙ্গভাষা’ কার্তিক ১৩১৪
- ‘রাসমনির ছেলে’ ⇒ ‘ভারতী’ আশ্বিন ১৩১৮
- ‘পণরক্ষা’ ⇒ ‘ভারতী’ পৌষ ১৩১৮
- ‘হালদার গোষ্ঠী’ ⇒ ‘সবুজপত্র’, বৈশাখ ১৩২১
- ‘হৈমন্তী ’ ⇒ ‘সবুজপত্র’, জ্যৈষ্ঠ ১৩২১
- ‘বোষ্টমী’ ⇒ ‘সবুজপত্র’, আষাঢ় ১৩২১
- ‘স্ত্রীর পত্র’ ⇒ ‘সবুজপত্র’, শ্রাবণ ১৩২১
- ‘ভাইফোঁটা’ ⇒ ‘সবুজপত্র’, ভাদ্র ১৩২১
- ‘শেষের রাত্রি ’ ⇒ ‘সবুজপত্র’, আশ্বিন ১৩২১
- ‘অপরিচিতা’ ⇒ ‘সবুজপত্র’, কার্তিক ১৩২১
- ‘তপস্বিনী’ ⇒ ‘সবুজপত্র’, জ্যৈষ্ঠ ১৩২৪
- ‘পয়লা নম্বর’ ⇒ ‘সবুজপত্র’, আষাঢ় ১৩২৪
- ‘পাত্র ও পাত্রী’ ⇒ ‘সবুজপত্র’, পৌষ ১৩২৪
- ‘নামঞ্জুর গল্প’ ⇒ ‘প্রবাসী’, অগ্রহায়ন ১৩৩২
- ‘সংস্কার’ ⇒ ‘প্রবাসী’, আষাঢ় ১৩৩৫
- ‘বলাই’ ⇒ শান্তিনিকেতনের বর্ষা উৎসবে পঠিত, ১৩৩৫
- ‘চিত্রকর’ ⇒ শান্তিনিকেতনের বর্ষা উৎসবে পঠিত, ১৩৩৬
- ‘চোরাই ধন’ ⇒ গ্রন্থাকারে , ১৩৪০
- ‘রবিবার’ ⇒ ‘শারদীয় আনন্দবাজার’, ১৩৪৬
- ‘শেষকথা’ ⇒ ‘শনিবারের চিঠি’ ১৩৪৭
- ‘ল্যাবরেটরি’ ⇒ ‘শারদীয় আনন্দবাজার’, ১৩৪৭
- ‘বদনাম’ ⇒ ‘প্রবাসী’ আষাঢ় ১৩৪৮
- ‘প্রগতি সংহার’ ⇒ ‘শারদীয় আনন্দবাজার’, ১৩৪৮
- ‘শেষ পুরস্কার’ ⇒ বিশ্বভারতী পত্রিকা, শ্রাবণ ১৩৪৯
- ‘মুসলমানীর গল্প’ ⇒ ‘ঋতুপত্র’ আষাঢ় ১৩৬২
- ‘গল্পগুচ্ছ’ (১৯০৮-০৯)
- ‘লিপিকা’ (১৯২২)
- ‘সে’ (১৯৩৭),
- ‘তিন সঙ্গী’ (১৯৪০)
- ‘গল্পসল্প’ (১৯৪১) ।
গল্পগুচ্ছ :
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ছোট গল্পের সংকলন - গল্পগুচ্ছ। এতে ৯১ টি গল্প রয়েছে। ১৯০৮-১৯০৯ সালের মাঝে এই সংকলন পাঁচ খন্ডে প্রকাশিত হয়। রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা সাহিত্যের ছোট গল্প গুলোর মধ্যে এই সংকলনটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংকলন। ঘাটের কথা, দেনা-পাওনা, কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, অপরিচিতা ইত্যাদির মতো বিখ্যাত ও হৃদয়স্পর্শ করার মতো ছোট গল্প দ্বারা বইটি সাজানো হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার নিপুন ভাষায় বাস্তবিকতাকে প্রতিটি গল্পে তুলে ধরেছে।
লিপিকা :
লিপিকার (১৩২৯ বঙ্গাব্দ/ আগস্ট ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দ) গল্পগুলোকে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘কথিকা’। লিপিকায় মোট ৩৯টি গল্প আছে। এর মধ্যে প্রথম গল্পটির নাম ‘পায়ে চলার পথ’। এটি প্রকাশিত হয় প্রবাসীর আশ্বিন ১৩২৬ সংখ্যায়। যদিও প্রবাসীর আগে সবুজপত্রের মাঘ ১৩২৪, ফাল্গুন ১৩২৫, বৈশাখ ১৩২৬ ও আষাঢ় ১৩২৬ সংখ্যায় যখাক্রমে ‘তোতা-কাহিনী’, ‘স্বর্গ-মর্ত’, ‘ঘোড়া’ ও ‘প্রথম শোক’ গল্পগুলো ছাপা হয় (এর মধ্যে পত্রিকায় প্রকাশের সময় ‘ঘোড়া’ ও ‘প্রথম শোক’ রচনা দুটির শিরোনাম ছিল যথাক্রমে ‘মুক্তির ইতিহাস’ ও ‘কথিকা’)। লিপিকার এই গল্পগুলো রচনার একটি পটভূমি আছে।
‘সে ‘ :
‘সে' গ্রন্থটির প্রকাশকাল বৈশাখ, ১৩৪৪ (ইং ১৯৩৭)। রবীন্দ্রনাথের ধারায় ‘সে’ একটি স্বতন্ত্র সৃষ্টি। ১৪ অধ্যায় বিন্যস্ত ‘সে’ গ্রন্থের প্রধান গল্পকথক 'আমি' শ্রোেত পুপদি, আর 'সে' কখনও অপ্রধান গল্পকথকের ভূমিকায় এসেছে। এই 'সে' হল মূলক লেখকের আজগুবি গল্পের মূল অবলম্বন, অসম্ভব গল্পের বহুরূপী। লেখকের ভাষায় 'সে' হল 'নামহারা বানানো মানুষ' 'কেবল বাক্য দিয়ে তৈরি'। রবীন্দ্র মানসে যেসব অসম্ভব কল্পনা ভিড় করে এসেছে ‘সর্বনামধারী’ এই 'সে' চরিত্রটিকে আশ্রয় করে তাকে গল্পরূপ দিয়ে লেখক পুপুদিকে আর পাঠকসমাজে শুনিয়েছেন।
‘তিনসঙ্গী' গল্প সংকলন :
- রবীন্দ্রনাথের ‘তিনসঙ্গী’ গল্প সংকলনে তিনটি গল্প আছে—‘রবিবার’, ‘শেষ কথা' ও 'ল্যাবরেটরি ।
- গল্পগুলি তাঁর শেষ জীবনে ১৯৩৯-৪০ খ্রিস্টাব্দে লেখা।
- গল্পগুলি ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় প্রকাশিত হয়েছিল।
‘গল্পস্বল্প‘ :
‘গল্পসল্প প্রকাশিত হয় ১৩৪৮ সনের ২৭ বৈশাখ (১০ মে ১৯৪১), অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর কয়েক মাস আগে। যদিও ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি যখন অসুস্থ অবস্থায় কালিম্পংয়ে, তখনই বইটির নামপত্র এঁকে রাখেন। দু-তিনটি বাদে গল্পসল্পের গল্পগুলো রবীন্দ্র-জীবনের একেবারে শেষ বছরে (১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দ) লেখা। ব্যতিক্রম ‘পালের সঙ্গে দাঁড়ের বুঝি’ (১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দ) ও ‘যেমন পাজি, তেমনি বোকা’ (১৯৪০) এ-দুটি গল্প। ‘ইঁদুরের ভোজ’ গল্পটিও কিছু আগে লেখা বলে ধারণা করা যায়, যেহেতু এ-গল্পটি বঙ্গলক্ষ্মী পত্রিকার আষাঢ় ১৩৪৬ (১৯৩৯) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। তখন অবশ্য গল্পটি সেখানে রবীন্দ্রনাথের নাতনি নন্দিনীর নামে ছাপা হয়। গল্পসল্প যখন প্রথম বই আকারে বেরোয় তখন এ-গল্পটি তাতে ছিল না। অনেক পরে ১৩৭২ সনের (১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দ) সংস্করণে এটি সংযোজিত হয়।
গল্পের বিষয় অনুযায়ী শ্রেণীবিভাগ :
সাধারণ সূখ - দুঃখের গল্প : ‘রামকানাইয়ের নির্বুদ্ধিতা’, ‘ব্যবধান’, ‘শাস্তি’, ‘দিদি’, ‘রাসমনির ছেলে’, ‘পণরক্ষা’, ‘দান
প্রতিমা’, ‘ছুটি’, ‘কাবুলিওয়ালা’ ইত্যাদি ।
পারিবারিক - সমাজিক গল্প : ‘ঠাকুরদা’, ‘সম্পত্তি সমর্পণ’, ‘হালদার গোষ্ঠী’, ‘স্বর্ণমৃগ’ ইত্যাদি ।
প্রেমের গল্প : ‘একরাত্রি’, ‘মহামায়া’, ‘সমাপ্তি’, ‘দৃষ্টিদান’, ‘মাল্যদান’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘প্রায়শ্চিত্ত’, ‘মানভঞ্জন’, ‘দুরাশা’,
‘শেষের রাত্রি’ ইত্যাদি ।
অতি - প্রাকৃত গল্প : ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘নিশীথে’, ‘মণিহারা’, ‘কঙ্কাল’, ‘জীবিত ও মৃত’ ইত্যাদি ।
নাগরিক জীবনের ব্যতিক্রমী গল্প : ‘রবিবার’, ‘ল্যাবেরেটরী’, ‘শেষকথা’ ।
রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের প্রথম পর্ব :
রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের প্রথম পর্বের উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি হল -- ‘কঙ্কাল’, ‘অতিথি’, ‘ত্যাগ’, ‘একরাত্রি’, ‘কাবুলিওয়ালা', 'ছুটি', 'নিশীথে', 'ক্ষুধিত পাষাণ', ‘নষ্টনীড়’ প্রভৃতি।
গল্পগুলির বৈশিষ্ট্য :
প্রথম পর্বের গল্পগুলির বেশিরভাগই পদ্মাতীরে বসে লেখা। বাংলা গ্রামজীবনের নৈকট্য, বোটে পদ্মাবাস এগুলিকে এমন সরস প্রাণরসে পূর্ণ করেছেন যার তুলনা মেলা ভার। মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে একটি নিগূঢ় সম্পর্ক কবি আবিষ্কার করেছেন। সাধারণ মানুষের জীবনের ছোটো ছোটো হাসি কান্না, সুখ-দুঃখ এই গল্পের মধ্যে রূপলাভ করেছে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের দ্বিতীয় পর্ব :
রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের দ্বিতীয় পর্বের উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি হল --‘হালদার গোষ্ঠী’, ‘স্ত্রীর পত্র’, ‘পয়লা নম্বর' প্রভৃতি।
গল্পগুলির বৈশিষ্ট্য :
এই পর্বের ছোটো গল্পগুলিতে নাগরিক বাচনভঙ্গি এবং ভাবকল্পনার বিশিষ্টতা প্রকাশিত। নাগরিক চাতুর্য এবং বাকবৈদগ্ধ্যের নৈপুণ্য, উইটের দীপ্তিতে, ক্ষুরধার মন্তব্যে এবং গূঢ় তির্যকতায় এই গল্পগুলি হয়ে উঠেছে চমকপ্রদ। মানুষের নতুন মূল্যবোধের দিকে লেখকের দৃষ্টি পড়েছে।
রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের তৃতীয় পর্ব :
রবীন্দ্রনাথের ছোটো গল্পের তৃতীয় পর্বের উল্লেখযোগ্য গল্পগুলি হল -‘তিনসঙ্গী’ এছাড়াও ‘লিপিকা’র বেশিরভাগ লেখা ‘সে’ এবং ‘গল্পসল্প’ বই-এ ছোটোগল্পের নানাবিধ পরীক্ষা চলেছে।
গল্পগুলির বৈশিষ্ট্য :
তৃতীয় পর্বের গল্পে বাচনভঙ্গির তির্যকতা এবং ভাব-চেতনার আধুনিকতা তথা তত্ত্বপ্রাধান্য লক্ষণীয়। প্রথম গল্প ‘রবিবার’ একটি মনোরম প্রেমকাহিনি, দ্বিতীয়টি আরণ্যক জৈবতার মতো অন্ধ আকর্ষণ থেকে অচিরার পুনরুদ্বোধন এবং নবীন মাধবের অনিচ্ছালব্ধ মুক্তি শেষ কথা”) এবং তৃতীয়টিতে সোহিনী নামে এক জ্যোতির্ময়ীর প্রলোভনের অগ্নিচক্র রচনা করে নন্দকিশোরের বিজ্ঞানযজ্ঞের ঋত্বিককে বিফল সন্ধান ('ল্যাবরেটরি')।
ছোটো গল্পে রোমান্স রসসৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের সাফল্য :
ছোটো গল্পে রোমান্স রসসৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথ সাফল্য দেখিয়েছেন। 'দালিয়া’, ‘দুরাশা’' প্রভৃতি গল্পে ইতিহাসগন্ধী রোমান্স রস মিলন মাধুর্যে এবং আশাভঙ্গের হাহাকার যেভাবে প্রকাশিত, কবির ঐতিহাসিক রোমান্স জাতীয় উপন্যাস দুটিতে তার চিহ্নমাত্র নেই। রবীন্দ্রনাথের অতিপ্রাকৃত ছোটো গল্পগুলির বৈশিষ্ট্য লেখো। রবীন্দ্রনাথের অতিপ্রাকৃতের সঙ্গে ভৌতিকভাবের সম্পর্ক মাত্র নেই। মানবচিত্তের স্বপ্ন কল্পনা বা পাপবোধ কিংবা আন্তরিক দুর্বলতা এবং স্পর্শকাতরতা সত্য ও মায়ার বিভ্রম রচনা করে অতিপ্রাকৃত রস ঘনীভূত করে তুলেছে। 'মণিহারা’, ‘ক্ষুধিতপাষাণ’, ‘নিশীথে’ প্রভৃতি গল্পগুলি তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

No comments