রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে রোম্যান্টিক ভাবালুতার ফলে যে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তাতে বিষ্ণু দে-র ঐতিহ্যসচেতেন খাঁটি নৈর্ব্যক্তিকতা ন...
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যে রোম্যান্টিক ভাবালুতার ফলে যে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তাতে বিষ্ণু দে-র ঐতিহ্যসচেতেন খাঁটি নৈর্ব্যক্তিকতা নিয়ে এসেছিল এক মুক্ত বায়ু। আধুনিক কবিদের কাছে রবীন্দ্র-বিশ্ব ছিল এক স্বপ্নের ডুবন – সুধীন্দ্রনাথ যাকে 'পরীর রাজ্য' আখ্যা দিয়েছিলেন। 'এলিঅটের অবিতা বং এর ভূমিকায় - বিষ্ণু দে আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনা সম্পর্কে লিখেছিলেন ---
'রৌদ্রের এ অভিযান আরম্ভ শিক্ষিত বাবুসমাজের যে রাত্রিশেষে, যে রাত্রি আশা ভঙ্গের, জিজ্ঞাসার, আত্মসচেতনতার, যে আন্দোলনের রাত্রিতে আসে সংগঠনের প্রভাত। এলিঅটের প্রভাব সেখানে রূপকবৎ যে রূপক খুলল গান্ধীজীর নীতির গোধূলিতে, রবীন্দ্রনাথের সমর্থ নিভৃতিতে লালিত খোলা হাওয়ার ধ্যানধারণায় ... “।
পরিচয় :
বিষ্ণু দে কলকাতার পটলডাঙার বিখ্যাত শ্যামাচরণ দে বিশ্বাসের পরিবারে ১৯০৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জুলাই জন্মগ্রহন করেন । আদি নিবাস ছিল হাওড়ায়। তাঁর পিতা অবিনাশ চন্দ্র দে ছিলেন একজন অ্যাটর্নি। বিষ্ণু দে কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউট এবং সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল-এ পড়াশোনা করেন । ১৯২৭ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর বঙ্গবাসী কলেজে আইএ পড়তে যান। ১৯৩২ সালে সাম্মানিক ইংরাজি বিষয়ে স্নাতক হন সেন্ট পল্স কলেজ থেকে। এরপর ১৯৩৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরাজিতে এম এ করেন। ১৯৩৫ সালে তিনি রিপন কলেজে (অধুনা সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) যোগদান করেন শিক্ষক হিসেবে। এরপর তিনি কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজেও অধ্যাপনার কাজ করেছেন। তিনি বামপন্থী দর্শন দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। এছাড়া কবি টি এস এলিয়টের রচনাশৈলী এবং ভাবনা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিষ্ণু দে ৩ ডিসেম্বর ১৯৮২ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান ।
ছদ্মনাম :
- ‘শ্যামল রায়’ ,
- ‘বিপ্রদাস মিত্র’ ।
রচনাসমূহ :
প্রথম রচনা :
(a) প্রথম গল্প -- ‘পুরাণের পুনর্জন্ম’ (বিপ্রদাস মিত্র ছদ্মনামে রচনা করেন, গল্পটি ‘প্রগতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় )।
(b) প্রথম কাব্যগ্রন্থ- ‘উর্বশী ও আর্টেমিস’ (১৯৩২) ।
(c) প্রথম প্রকাশিত অনুবাদ গ্রন্থ - ‘ক্যারামেল ডল’ ।
পত্রিকা সম্পাদনা :
- ‘কবিতা’ ,
- ‘সাহিত্যপত্র’।
বিষ্ণু দে-র কাব্যগ্রন্থ :
বিষ্ণু দে ‘র কাব্যগ্রন্থগুলি হল —
- 'ঊর্ব্বশী ও আর্টেমিস' (১৯৩২),
- ‘চোরাবালি’ (১৯৩৭),
- ‘পূর্বলেখ' (১৯৪১),
- 'সাত ভাই চম্পা' (১৯৪৫),
- 'সন্দীপের চর’ (১৯৪৭),
- ‘অন্বিষ্ট' (১৯৫০),
- 'নাম রেখেছি কোমলগান্ধার' (১৯৫৩),
- 'আলেখ্য' (১৯৫৮),
- 'তুমি শুধু পঁচিশে বৈশাখ (১৯৫৮),
- ‘স্মৃতি-সত্তা-ভবিষ্যৎ’ (১৯৬৩),
- 'সেই অন্ধকার চাই' (১৯৬৬),
- 'সংবাদ মূলত কাব্য' (১৯৬৯),
- ‘ইতিহাসে ট্রাজিক উল্লাসে উল্লাসে' (১৯৭০),
- 'ঈশ্বাবাস্য দিবানিশা' (১৯৭৪),
- 'চিত্ররূপমত্ত পৃথিবীর' (১৯৭৫),
- 'উত্তরে থাকো মৌন’ (১৯৭৭),
- ‘আমার হৃদয়ে বাঁচো’ (১৯৮১) ।
- 'রবি করোজ্জ্বল’ (১৯৭১)
- ‘নিজদেশে' (১৯৭৩)।
আত্মজীবনী :
- ‘ছড়ানো এই জীবন’
অনুবাদ কাব্যঃ
- 'এলিয়েটের কবিতা' (১৯৫৩),
- 'হে বিদেশী ফুল' (১৯৫৬),
- 'মাও সে তুং-এর কবিতা' (১৯৫৮) ইত্যাদি৷
প্রবন্ধ গ্রন্থঃ
- ‘রুচি ও প্রগতি' (১৯৪৬),
- 'সাহিত্যের ভবিষ্যৎ' (১৯৫২),
- 'এলোমেলো জীবন ও শিল্পসাহিত্য' (১৯৫৮),
- 'রবীন্দ্রনাথ ও শিল্পসাহিত্যে আধুনিকতার সমস্যা' (১৯৬৫),
- 'মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জিজ্ঞাসা (১৯৬৭),
- ‘জনসাধারণের রুচি’ (১৯৭৫),
- 'যামিনী রায়'সহ (১৯৭৭) ইত্যাদি।
পুরস্কার ও সম্মাননা :
- ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার, নেহরু স্মৃতি পুরস্কার পান ।
- ১৯৭১ সালে ‘স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যৎ’ গ্রন্থের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার লাভ করেন।
- 'রুশতি পঞ্চশতীর' জন্য' সোভিয়েত ল্যান্ড পুরস্কার পেয়েছিলেন।
আলোচনা :
"উর্বশী ও আর্টেমিস" :
"চোরাবালি" :
"সাত ভাই চম্পা":
"সন্দীপের চর":
"অন্বিষ্ট":
- এটি কবি বিষ্ণু দে'র প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ।
- এই কাব্যগ্রন্থে মোট কবিভার সংখ্যা ২৬টি।
- এই কাব্যগ্রন্থের সুচনা কবি টি.এস.এলিয়টের উদ্ধৃতি দিয়েছিলেন।
- এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা - "পলায়ন"।
- এই কাব্যগ্রন্থের “সাগর উত্থিতা" কবিতায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'চিত্রা' কাব্যের বিস্তায়িনী' কবিতার প্রভাব সুস্পষ্ট লক্ষ্য করা যা
- এটি কবি বিষ্ণু দে'র দ্বিতীয় প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।
- কাব্যগ্রন্থটির কবিতাগুলির রচনাকাল ১৯২৬-১৯৩৬ সাল পর্যন্ত।
- এই কাব্যগ্রন্থে মোট ২১ টি কবিতা রয়েছে।
- এই কাব্যগ্রন্ডের প্রথম ও শ্রেষ্ঠ কবিতা- "ঘোড়সওয়ার ।
- এই কাব্যগ্রন্থে টি. এস. এলিয়ট এর "দ্য ওয়েস্টল্যান্ড" এবং "দ্য হলো মন" কাব্যগ্রন্থের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
- এটি কবি বিষ্ণু দে'র পঞ্চম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।
- এই কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ৪৪টি।
- বাংলার সংগ্রামীদের কাহিনী নিয়ে "সাত ভাই চম্পা" কাব্যগ্রন্থটি রচিত।
- কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা “২২ শে জুন, ১৯৪১”।
"সন্দীপের চর":
- এটি কবি বিষ্ণু দে'র ষষ্ঠ প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।
- এই কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ৩৫টি।
- এই কাব্যগ্রন্থের নাম কবিতাটি কবি মোহন সেনের উদ্দেশ্যে রচনা করেন।
- এই কাব্যগ্রন্থের শেষ কবিতা “১৫ ই আগস্ট"।
"অন্বিষ্ট":
- এটি কবি বিষ্ণু দে'র সপ্তম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ।
- এই কাব্যগ্রন্থে মোট কবিতার সংখ্যা ১৫টি।
- কাব্যগ্রন্থটির শেষ কবিতা "জলদাও"। এই কবিতার বিষয় - দেশ ভাগ, সাম্প্রদায়িক হানাহানি ।
- এই কাব্যগ্রন্থের ‘না ‘ কবিতাটি তাঁর রচিত অন্যতম দীর্ঘ করিতা। কবিতাটির ৫৪১ টি পঙতি ।
বিষ্ণু দে-র কাব্য বৈশিষ্ট্যঃ
১. বিষ্ণু দে-র কাব্যে রবীন্দ্র স্মরণ ঘটেছে বারবার। প্রথমদিকে এর স্মরণে ছিল তীর্ঘকতা শেষের দিকে সে স্মরণে এসেছে গভীর শ্রদ্ধা।
২। এলিয়টের কবিতা তাঁর কাব্যকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে।
৩। যুগের ক্লান্তি, হতাশা, যন্ত্রণা, বিশ্বযুদ্ধোত্তর নীতিভ্রষ্টতা বিষ্ণু দে-কে অনেকাংশে নৈরাশ্যবাদী কবি করে তুলেছে ।
৪। দেশি ও বিদেশি পুরাণ তাঁর কবিতায় নানাভাবে উপস্থিত হয়েছে। উর্বশী, নচিকেতা, শর্মিষ্ঠা, চাঁদবনিকের মতো দেশি পৌরাণিক চরিত্রের পাশাপাশি ক্রেসিডা, হেলেন, ওফেলিয়া প্রভৃতি বিদেশি পৌরাণিক প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়েছে।
৫। তিনি নাগরিক কবি। নগর জীবনের জটিলতাকে রূপায়িত করতে গিয়ে তাঁর কাব্য অনেকাংশে হয়ে উঠেছে দুর্বোধ্য।
৬। আধুনিক যুগ তাঁর কাছে ‘চোরাবালি’-তে পরিণত হয়েছে।

No comments