কৃত্তিবাস কীর্তিবাস কবি, এ বঙ্গের অলংকার’ –কৃত্তিবাস সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদনের এই স্তুতি যথার্থ। তিনি সত্যই এ বঙ্গের অলংকার। তিনি অনুবাদ স...
কৃত্তিবাস কীর্তিবাস কবি, এ বঙ্গের অলংকার’ –কৃত্তিবাস সম্পর্কে মাইকেল মধুসূদনের এই স্তুতি যথার্থ। তিনি সত্যই এ বঙ্গের অলংকার। তিনি অনুবাদ সাহিত্যের আদি কবি। সেজন্য তিনি বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের পথিকৃৎ। তাঁর অনুবাদ আমাদের বাঙালি জীবনের ঘরোয়া মর্মস্পর্শী মর্মানুবাদ। তাই তাঁর ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ আজও বাঙালির ঘরে ঘরে সমাদৃত হয়। কবি নিজে রামায়ণ রচনার কারণ হিসেবে বলেছেন, ‘লোক বুঝাইতে কৈলা কৃত্তিবাস পণ্ডিত’।
বংশ পরিচয়ঃ
পশ্চিমবঙ্গের গঙ্গা তীরবর্তী নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রামে কৃত্তিবাস ওঝা জন্মগ্রহন করেন । তাঁর পূর্বপুরুষ মুরারী ওঝার পৌত্র বনমালী ওঝার পুত্র কৃত্তিবাস । মাতার নাম মালিনী । ‘আত্মপরিচয়’ অংশে তিনি লিখেছেন ---- ‘মালিনী নামেতে মাতা, পিতা বনমালী’ ।
জন্ম তারিখঃ
কবি কৃত্তিবাসের জন্ম তারিখ নিয়ে বহু চর্চা করা হয়েছে । কিন্তু কোনো সাহিত্য সমালোচক সঠিক সিধান্তে আসতে পারেন নি । ‘আত্ম পরিচয়’ অংশ থেকে জানা যায় -- মাঘ মাসের শেষ দিনে পঞ্চমী তিথিতে জন্মগ্রহন করেন :
‘‘আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুণ্য মাঘমাস ।তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস ।।”
-- কিন্তু কোথায় কোনো সাল বা শকাব্দের উল্লেখ নেই । কুলজী ঘেটে ১৩৯৯ খ্রিষ্টাব্দে কবির জন্ম বলে সমর্থনের চেষ্টা করা হয়েছে । যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি জ্যোতিষ গণনার সাহায্যে ১৩৮৬ - ১৩৯৮ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে কবির জন্ম বলে মনে করেন।
সুতরাং কবি চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে পঞ্চদশ মতাব্দীর প্রথমার্ধ সময়কালের মধ্যে বর্তমান ছিলেন ।
কাব্য নামঃ
কৃত্তিবাসের অনুদিত কাব্যের নাম -- ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ ।
খন্ড বিভাগঃ
কবি কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ কাব্যটি মোট ৭টি খন্ডে বা কান্ডে বিভক্ত । যথাঃ
(i) আদি কান্ড,
(ii) অযোধ্যা কান্ড,
(iii) অরণ্য কান্ড,
(iv) কিস্কিন্ধ্যা কান্ড,
(v) সুন্দর কান্ড,
(vi) লঙ্কা কান্ড,
(vii) উত্তর কান্ড ।
প্রকাশকালঃ
উইলিয়ম কেরি সাহেবের উদ্যোগে শ্রীরামপুর খ্রিষ্টান মিশনারী প্রেস থেকে ১৮০১-০৩ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে ৫টি খন্ডে কৃত্তিবাসের ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ প্রকাশিত হয় । বইটির ইংরাজি নামপত্রে তারিখ আছে ১৮০২ সাল । কিন্তু বাংলা নামপত্রে রয়েছে ১৮০৩ সাল ।
ছন্দঃ
কৃত্তিবাস তাঁর ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ কাব্যটি সরল বাংলা ত্রিপদী ছন্দে রচনা করেছেন ।
সংযোজন ও বিয়োজনঃ
কৃত্তিবাসের কাব্যটি ঠিক আক্ষরিক অনুবাদ গ্রন্থ নয়, এটি মূলত ভাবানুবাদ প্রধান কাব্য । তাই কবি তার কাব্যে মূল রামায়ণ অনেকাংশে বিয়োজন করেছেন, তেমনি নতুন নতুন বিষয় সংযোজন করেছেন ।
বিয়োজনঃ
(a) কার্তিকের জন্ম,
(b) বশিষ্ঠ বিশ্বমিত্রের বিরোধ,
(c) অশ্বরীশ যজ্ঞ,
(d) রামচন্দ্র কর্তৃক আদিত্য হ্রদয়স্তব পাঠ ।
সংযোজনঃ
(a) দস্যু রত্নাকর উদ্ধার,
(b) গনেশের জন্ম,
(c) সম্ভুরাসুর বধ,
(d) কৈকেয়ীর বরলাভ,
(e) হনুমান কর্তৃক রাবণের মৃত্যুবাণ হরণ,
(f) লব-কুশ যুদ্ধ ।
কাহিনী সংগ্রহঃ
কৃত্তিবাস তাঁর কাব্যের কাহিনি সংগ্রহ করেছিলেন বাল্মীকি রামায়ণ, জৈমিনীর ভারত-সংহিতা, দেবী ভাগবত, স্কন্দপুরাণ, বৃহদ্ধর্ম পুরাণ, কালিকা পুরাণ, পদ্মপুরাণ প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে।
‘শ্রীরাম পাঁচালী’ নামকরণের কারণঃ
বাল্মীকি বিরচিত সংস্কৃত রামায়ণ থেকে তাঁর অনূদিত বাংলা রামায়ণকে কবি কৃত্তিবাস নাম দিয়েছিলেন ‘রামায়ণ পাঁচালী' বা 'শ্রীরাম পাঁচালী'। তিনি ‘লোক বুঝাবার তরে' রামকথা সহজ সরলভাষায় পরিবেশন করেছেন। লোকসাধারণের জন্য সহজ ভাষায় পরিবেশিত পদ্যাকার কাহিনিকেই পাঁচালী বলে। কৃত্তিবাসের রামকথার লক্ষ্য ছিল আপামর বাঙালি শ্রোতা। তাই কবি তাঁর অনূদিত রামায়ণকে 'রামায়ণ পাঁচালী’ বা ‘শ্রীরাম পাঁচালী' বলেছেন।
‘কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙালরি জাতীয় মহাকাব্যঃ’
বাঙালির প্রাণের কাব্য কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙালির দিবসরজনীর সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষার দ্যোতনা কৃত্তিবাসি রামায়ণ । গার্হস্থ্য জীবনাদর্শ ও সত্যনিষ্ঠার সমন্বয়ে কৃত্তিবাসের রামায়ণ বাঙালির জাতীয় মহাকাব্য।
কৃত্তিবাসের কাব্যমূল্যঃ
কৃত্তিবাসি রামায়ণে বাল্মীকির ঘনপিনদ্ধ শিল্পরূপ তথা কাব্যমূল্য খোঁজা বৃথা। কৃত্তিবাস বাল্মীকি নন। কৃত্তিবাসি রামায়ণকে কৃত্তিবাসি স্বরূপে বিচার করতে হবে। বাংলাদেশের পরিচিত জীবন থেকে লৌকিক উপমা রূপকাদি ব্যবহার করে কৃত্তিবাস বক্তব্যকে খুবই তীর্যক ও তীক্ষ্ণ করে তুলেছেন। অলংকার প্রয়োগে কবির কৃতিত্ব এই যে সংস্কৃত অলংকারের সঙ্গে দৈনন্দিন বাঙালির জীবন স্থান পেয়েছে। ফলে কৃত্তিবাসের সৃজনশীল প্রতিভা শিল্পসৌকর্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের বৈশিষ্ট্যঃ
বাঙালি ও বাংলার কবি কৃত্তিবাস বাল্মীকিকৃত সংস্কৃত রামায়ণের কাঠামোর মধ্যে নিজের কবি কল্পনাকে মূর্ত করে বাঙালির মন নিয়ে বাঙালির মতো রামায়ণ রচনা করেছেন। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য বাঙালি ভাবালুতা ও বৈষ্ণুবীয় ভক্তিবাদ।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের মৌলিকতাঃ
কৃত্তিবাসি রামায়ণে বাঙালি খুঁজে পেয়েছে তার হৃদয়ের ভাষা ও প্রাণের আকুতি। সংস্কৃত রামায়ণের কাহিনি, প্রেক্ষাপট ও চরিত্রগুলি অবিকৃত রেখে কৃত্তিবাস বাঙালির জীবনধর্মকে রসসৌকর্যে মণ্ডিত করে তুলেছেন। এখানেই তাঁর মৌলিকতা।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের বাঙালীয়ানাঃ
কৃত্তিবাসি রামায়ণে বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের ছায়াপাত ঘটেছে। রাম-লক্ষ্মণের সৌভ্রাতৃত্ব, সীতার সর্বংসহ দুঃখময় বধূজীবন, হনুমানের দাস্যভক্তি, সুগ্রীব-বিভীষণের সৌহার্দ্য বাঙালি ঘরের জিনিস হয়ে উঠেছে। কৃত্তিবাসী রামায়ণের চরিত্রগুলি কাশী-কোশল-মগধ-বিদিশা পরিত্যাগ করে বাঙালির গৃহাঙ্গনে অবতীর্ণ। কৃত্তিবাস বাঙালির মন নিয়ে বাঙালির মতো করে বাঙালি জীবনের মহাকাব্য রচনা করেন।
কৃত্তিবাসী রামায়ণের জনপ্রিয়তাঃ
বাঙালি জাতির অস্তরে কৃত্তিবাসি রামায়ণ চিরস্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছে। আর্য রামায়ণ যেমন প্রাচীন ভারতবর্ষকে রক্ষা করেছিল, তেমনি কৃত্তিবাসি রামায়ণ বাংলাদেশকে শান্ত স্নিগ্ধ জীবনাদর্শের মধ্যে নির্ভয় আশ্রয় দিয়েছে। সেজন্য, বাঙালি জীবনের ওপর দিয়ে নানা সংকট ও ঝড়-ঝঞ্ঝা বয়ে গেলেও, জীবনের মূল্য সম্বন্ধে এ জাতির আমূল মানসিক পরিবর্তন হয়নি। বাঙালির দৈনন্দিন জীবন ও মানসিক ঐতিহ্যের প্রতিটি পর্যায়ের সঙ্গে কৃত্তিবাসি রামায়ণ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। তাই ধনী-নির্ধন নির্বিশেষে সকলের মধ্যে এই কাব্য অখণ্ড জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
‘শ্রীরাম পাঁচালী - মহাকাব্য না পাঁচালী ?
প্রাচীনযুগে কৃত্তিবাসের 'রামায়ণ পাঁচালী' কাব্য বলেই পরিগণিত হত। সুর করে টেনে ঢেনে পদ্যপাঠের রীতিকে পাঁচালি বলে। মধ্যযুগের প্রায় সমস্ত কাব্যই পাঁচালির ঢঙে লেখা হত। মহাকাব্যের ধারণা সে যুগে ছিল না। তা ছাড়া পশ্চিম ও ভারতীয় অলংকার শাস্ত্রের নিয়ম অনুসরণ করে কাহিনি, চরিত্র, রসের ঐক্য ও রচনার উৎকর্ষ যদি বিচার করা যায়, তাহলে এই কাব্যকে যথার্থ মহাকাব্যও বলা যায় কিনা সন্দেহ। অথচ আধুনিক কালের অনেক পণ্ডিত কৃত্তিবাসের রামায়ণকে মহাকাব্য বলার পক্ষপাতী। সুতরাং, এটি একটি অমীমাংসিত বিতর্কিত বিষয়।
এক নজরে কৃত্তিবাস ওঝা |
1. অনুবাদ সাহিত্যের তথা সংস্কৃত রামায়নের আদি অনুবাদক কৃত্তিবাস ওঝা ।
2. কৃত্তিবাস আদি কবি বাল্মিকীর সংস্কৃত রামায়নের অনুবাদ করেছিলেন ।
3. কৃত্তিবাসের নিবাস ছিল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার ফুলিয়া গ্রামে ।
4. কৃত্তিবাসের পরিচয় সংক্রান্ত শ্লোকঃ ‘‘ মালিনী নামেতে মাতা পিতা বনমালী ” ।
5. কৃত্তিবাসের পিতার নাম বনমালী, মাতার নাম মালিনী ।
6. কৃত্তিবাসের পূর্ব পুরুষের উপাধি / পদবী ছিল মুখোপাধ্যায় । পারিবারিক শিক্ষাকতার বৃত্তিতে তারা ‘উপাধ্যায়’ ( ওঝা ) লাভ করেন ।
7. মৈথিলি ব্রাহ্মণদের অসমিয়া ভাষায় ‘ওঝা’ বলা হয় । ‘ওঝা’ শব্দটি এসেছে ‘উপাধ্যায়’ শব্দ থেকে ।
8. কৃত্তিবাস রুকনুদ্দিন বারবক শাহের রাজসভার পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন । তবে বেশিরভাগ সাহিত্য সমালোচক মনে করেন রাজা গনেশের রাজসভায় কৃত্তিবাস উপস্থিত ছিলেন ।
9. কৃত্তিবাস প্রদত্ত জন্ম সংক্রান্ত শ্লোকঃ
‘‘আদিত্যবার শ্রীপঞ্চমী পুন্য মাঘমাস।
তথি মধ্যে জন্ম লইলাম কৃত্তিবাস ।।”
10. কৃত্তিবাস চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে জন্মগ্রহন করেন ।
11. বিভিন্ন তথ্য সহযোগে কৃত্তিবাসের জন্মের যে সালটি উপস্থাপন করা হয তা হল ১৪৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ৬ জানুয়ারী।
12. কৃত্তিবাসের অনুদিত রামায়নের নাম ‘শ্রীরাম পাঁচালী’ ।
13. কৃত্তিবাসী রামায়ন রচিত হয় আনুমানিক পঞ্চদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে (১৩৯৮ - ৯৯ খ্রিষ্টাব্দে )।
14. উইলিয়ম কেরীর উদ্যোগে ১৮০২ - ০৩ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন থেকে কৃত্তিবাসী রামায়ন সর্বপ্রথম মুদ্রিত হয় ।
15. কৃত্তিবাসী রামায়ণকে দুই খন্ডে প্রকাশ করেন জয়গোপাল তর্কালঙ্কার শ্রীরামপুর মিশন থেকে (১৮৩০ – ৩৪ খ্রিষ্টাব্দে )। এটিই রামায়নের দ্বিতীয় সংস্করণ ।
16. জয়াননন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’ জীবনী গ্রন্থে কৃত্তিবাসের নাম আছে ।
17. কৃত্তিবাসী রামায়নের প্রধান বৈশিষ্ট্য বাঙালীয়ানা ।
18. কৃত্তিবাসী রামায়নের অঙ্গীরস করুন রস ।
19. কৃত্তিবাসী রামায়নের খন্ডের সংখ্যা সাতটি খন্ড ( আদিকান্ড, অযোধ্যা কান্ড, অরণ্য কান্ড, কিষ্কিন্ধ্যা কান্ড, সুন্দর কান্ড, লঙ্কা কান্ড ও উত্তর কান্ড )।
20. কৃত্তিবাসের রামায়নে প্রভাব রয়েছে বাল্মিকীর রামায়ন. জৈমিনির ভারত, দেবী ভাগবত, মার্কেন্ডেয় পুরাণ ইত্যাদি কাব্যের।
21. কৃত্তিবাস সরল বাংলা পয়ার ত্রিপদী ছন্দে বাল্মিকী রামায়নের মূল কাহিনীটিকে উপস্থাপন করেছেন ।
22. কৃত্তিবাসের রামায়ণ আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ভাবানুবাদ ।
23. ‘কৃত্তিবাস কবি এ বঙ্গের অলংকার’ - বলেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত ।
24. কৃত্তিবাসের কাহিনী প্রথম প্রকাশিত হয় ‘বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস’ গ্রন্থে ।
25. কৃত্তিবাসের আত্মবিবরনী প্রথম প্রকাশ করেন হারাধন দত্ত ভক্তনিধি ।
26. হ্যালহেড তাঁর ‘A Grammar of the Bengali Language’ গ্রন্থে কৃত্তিবাসের রামায়ণ থেকে উদাহরণ নিয়েছেন ।

No comments