ধর্মমঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি হলেন ঘনরাম চক্রবর্তী। ঘনরাম অষ্টাদশ শতাব্দীর শক্তিমান কবি। মঙ্গলকাব্যের ঐশ্বর্যযুগের...
ধর্মমঙ্গল কাব্যের সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বাধিক জনপ্রিয় কবি হলেন ঘনরাম চক্রবর্তী। ঘনরাম অষ্টাদশ শতাব্দীর শক্তিমান কবি। মঙ্গলকাব্যের ঐশ্বর্যযুগের শেষ পর্যায়ে রামেশ্বর ভট্টাচার্যের শিবায়ন, ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল এবং ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল নির্বাণোন্মুখ দীপশিখার মতো সর্বশেষ জ্যোতি। সুকুমার সেন লিখেছেন,
“ধর্মমঙ্গল রচয়িতাদের মধ্যে সবচেয়ে শিক্ষিত ও দক্ষ ছিলেন ঘনরাম চক্রবর্তী। ঘনরাম সুলেখক ছিলেন। তাঁহার রচনা সর্বাধিক পরিচিত ধর্মমঙ্গল কাব্য নামে” ।
ব্যক্তি পরিচয়ঃ
ঘনরামের ব্যক্তি পরিচয় সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন ও সুকুমার সেন কিছু তথ্য জানিয়েছেন। সেই তথ্যাদি অনুসরণে দেখা যায় —ঘনরামের নিবাস বর্ধমান জেলার কইয়ড্ পরগণার কৃষ্ণপুর গ্রামে। তার প্রপিতামহের নাম পরমানন্দ, পিতামহের নাম ধনঞ্জয়। ধনঞ্জয়ের দুই পুত্র–শঙ্কর ও গৌরীকান্ত। ঘনরামের পিতা হলেন গৌরীকান্ত, মাতা সীতা। (সুকুমার সেনের মতে—মা হলেন মহাদেবী)। ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে কবির জন্ম। কবি শৈশবে দুরস্ত স্বভাবের ছিলেন। সেজন্য কবির পিতা কবিকে সে সময়ে রামপুরের টোলে বিদ্যার্জনের জন্য প্রেরণ করেন। সেখানে তাঁর গুরু তাঁকে কবিপ্রতিভার জন্য 'কবিরত্ন’ উপাধি প্রদান করেন। বর্ধমানাধিপতি মহারাজ কীর্তিচন্দ্র রায়ের আদেশে ঘনরাম ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করেন।
কাব্য পরিচয়ঃ
ঘনরামের কাব্যের নাম ‘অনাদিমঙ্গল’। তবে অনেক ক্ষেত্রে ‘শ্রীধর্মসঙ্গীত’, ‘মধুরভারতী’ প্রভৃতি নামও ব্যবহার করেছেন কবি। তিনি কাব্য রচনায় দেবতার স্বপ্নাদেশের কোন বিবরণ উল্লেখ করেন নি। তা্নেই মনে করা হয় গুরুর আদেশেই তিনি কাব্য রচনা করেন। তবে কোথাও তিনি গুরু নাম উল্লেখ করেন নি।
কাব্য আলোচনাঃ
ঘনরামের কাব্য চব্বিশটি পালায় বিভক্ত এবং কাব্যের শ্লোক সংখ্যা ৯১৪৭। পালাগুলি হল—(১) স্থাপনা পালা, (২) ঢেকুর পালা, (৩) রঞ্জাবতীর বিবাহ পালা, (৪) হরিশ্চন্দ্র পালা, (৫) শালেভর পালা, (৬) লাউসেনের জন্মপালা, (৭) আখড়া পালা, (৮) ফলকনিৰ্ম্মাণ পালা, (৯) গৌড়-যাত্রা পালা, (১০) কামদল বধ পালা, (১১) জামতি পালা, (১২) গোলাহাট পালা, (১৩) হস্তিবধ পালা, (১৪) কাঙুরযাত্রা পালা, (১৫) কামরূপ যুদ্ধ পালা, (১৬) কানাড়ার স্বয়ম্বর পালা, (১৭) কানাড়ার বিবাহ পালা, (১৮) মায়ামুণ্ড পালা, (১৯) ইছাই বধ পালা, (২০) অঘোরবাদল পালা, (২১) পশ্চিম উদয় আরম্ভ পালা, (২২) জাগরণ পালা, (২৩) পশ্চিম উদয় পালা এবং (২৪) স্বর্গারোহণ পালা।
কাব্য রচনাকালঃ
ঘনরাম অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগেই তাঁর কাব্য ‘অনাদিমঙ্গল’রচনা করেন। কবি সন তারিখ উল্লেখ করে কাব্য সমাপ্ত করেছেন :
‘‘ সঙ্গীত আরম্ভকাল নাইক স্মরণ।শুন সবে যে কালে হইল সমাপন।।শক লিখে রামণ্ডণ রসসুধাকর।মার্গকাদ্য অংশে হংস ভার্গব বাসর।।সুলক্ষ বলক্ষ পক্ষ তৃতীয়ার্খ্য তিথি।যামসংখ্য দিয়ে সাঙ্গ সঙ্গীতের পুথি। “
--- যোগেশচন্দ্র রায় বিদ্যানিধি এবং বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে ঘনরামের সমাপ্তি কাল ১৬৩৩ শকাব্দ বা ১৭১১ খ্রিস্টাব্দ। তবে মনে করা হয় ঘনরাম চক্রবর্তী অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেন ।
কাব্য প্রকাশকালঃ
ঘনরামের কাব্য বঙ্গবাসী কার্যালয় (কলকাতা) থেকে ১২৯০ সনের ( ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দের ) চৈত্রমাসে মুদ্রিত হয় ।
কাব্যের পালাঃ
ঘনরাম চক্রবর্তীর ‘অনাদিমঙ্গল’ কাব্যের দুটি পালা। যথা ---
(a) রাজা হরিশ্চন্দ্রের পালা,
(b) ইছাই বধ পালা ।
কাব্যের চরিত্রঃ
(a) লাউসেনঃ
লাউসেন ধর্মের প্রভাবপুষ্ট। এই দৈবানুকূল্যের কথা বাদ দিলে এই চরিত্রটি মানবিক গুণে বৈশিষ্ট্যদ্যোতক। পিতামাতার প্রতি ভক্তি, ধর্মীয় প্রথানুসরণ, নির্ভীকতা ও অসামান্য বীরত্বের জাজ্জ্বল্য মূর্তি লাউসেন।
(b) রঞ্জাবতীঃ
সন্তানবৎসল মাতৃহৃদয়ের শাশ্বত-রমণীয় রূপটি ঘনরামের কাব্যে বিশিষ্টরূপে রঞ্জাবতী চরিত্রটিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। রঞ্জাবতী স্বর্গের শাপভ্রষ্ট নর্তকী হলেও স্নেহময়ী, সর্বদা পুত্রচিন্তায় অধীর মাতৃত্বের চিরন্তনী প্রতিমূর্তি।
(c) মহামদঃ
ভিলেন বা খলচরিত্র হিসেবে মহামদ চরিত্রটি ঘনরামের অনবদ্য সৃষ্টি। শঠতা, ক্রুরতা ও প্রতিহিংসা পরায়ণতায় মহামদ খুবই স্বাভাবিক ও জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
কাব্যের অভিনবত্বঃ
(a) ঘনরামের কাব্যই প্রথমে মুদ্রণ সৌভাগ্য লাভ করে।
(b) ঘনরামই মঙ্গলকাব্যধারার একমাত্র কবি যিনি কাব্য রচনায় স্বপ্নাদেশের কোনো উল্লেখ করেননি।
(c) ঘনরামের কাব্যে রাঢ় বাংলার ইতিহাস ও সমাজ, মানবিকতা ও আদর্শবোধ সুন্দরভাবে চিত্রিত।
(d) অষ্টাদশ শতাব্দীর অবক্ষয় সাহিত্যাদর্শের স্থলে তিনি এক বলিষ্ঠ প্রাণবান সতেজ ও নৈতিকতায় পরিশুদ্ধ উন্নত চরিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর কাব্যে।
কাব্যের ত্রুটিঃ
দীনেশচন্দ্র সেন ঘনরামের কাব্যে নিম্নলিখিত ত্রুটি লক্ষ করেছেন–
(a) একঘেয়ে বর্ণনা,
(b) করুণরসের অভাব,
(c) বীরচরিত্র গঠনে ব্যর্থতা,
(d) সুকুমার সেন ঘনরামের কাব্য আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, “ঘনরামের কাব্যের প্রধান গুণ স্বচ্ছন্দতা ও গ্রাম্যতাহীনতা।” তবে ইনি অনুপ্রাসজনিত ত্রুটির কথা বলেছেন।
কাব্যের বৈশিষ্ট্যঃ
ঘনরামের কাব্য বৈশিষ্ট্য আলোচনা করতে গিয়ে বলা যায় --
(a) স্বভাব কবিত্বের সঙ্গে পাণ্ডিত্যের সংযোগই ঘনরামের কাব্যকে বৈশিষ্ট্য দান করেছে।
(b) ঘনরামের ভাষা অত্যন্ত মার্জিত এবং উন্নত রুচির পরিচায়ক।
(c) যথাযথ অনুপ্রাস প্রয়োগ ঘনরামের রচনাকে অনেক সময় শ্রুতিমধুর করেছে ।
(d) ঘনরামের কাব্যে রাঢ় বাংলার ইতিহাস ও সমাজ, মানবিকতা ও আদর্শবোধ সুন্দরভাবে চিত্রিত।
(e) চরিত্র চিত্রণ সরল অনাড়ম্বর তির্যক বাগ্ভঙ্গিতে শিল্পচাতুর্যের প্রকাশ ঘটেছে ।
প্রভাবঃ
ঘনরাম শাস্ত্রপুরাণাদিতে পণ্ডিত ছিলেন। তাই তাঁর কাব্যে রামায়ণ, ভাগবত ও মহাভারতের ছায়াপাত ঘটেছে। লাউসেনের বাল্যলীলা কৃষ্ণের বাল্যলীলার অনুসারী। ইছাই ও লাউসেনের যুদ্ধ অনেকটা রাম-রাবণের যুদ্ধের আদর্শ অনুযায়ী রচিত। কাব্যের আরম্ভে কবি গণেশ, ধর্ম, শক্তিদেবী ও সরস্বতীর বন্দনা করেছেন।
মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ঘনরাম চক্রবর্তীর বিশিষ্টতাঃ
ঘনরাম মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি। অষ্টাদশ শতাব্দীর অবক্ষয় সাহিত্যাদর্শের স্থলে তিনি এক বলিষ্ঠ প্রাণবান সতেজ ও নৈতিকতায় পরিশুদ্ধ উন্নত চরিত্র তুলে ধরেছেন তাঁর কাব্যে। যদিও সাহিত্য-শিল্পের বিচারে তাঁর পাঁচালি প্রধান কাব্য তেমন কিছু মহৎ সৃষ্টি নয়— তবুও সমকালীন মঙ্গলকাব্যের নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে বিচিত্র কল্পনার বর্ণ সমাবেশে জীবনাদর্শগত উচ্চকোটির ভাবকল্পনায় তিনি এক উল্লেখযোগ্য কবি।
ধর্মমঙ্গল কাব্য রাঢ়ের জাতীয় মহাকাব্যঃ
ডঃ সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় ধর্মমঙ্গল কাব্যকে রাঢ় দেশের National Epic বা জাতীয় মহাকাব্য নামে অভিহিত করেছেন । কারণ, ধর্মমঙ্গলের প্রধান ঘটনা রাঢ়ভূমিকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হয়েছে। এই কাব্যে রাঢ় দেশের নিম্নশ্রেণীর জাতিদের চরিত্রের স্পষ্ট ছাপ রয়েছে । এই কাব্যের পটভূমিতে রাঢ়বঙ্গের ইতিহাস, সমাজ, রাষ্ট্র ও জীবনের চিত্র ফুটেছে ।
এক নজরে ঘনরাম চক্রবর্তী |
1. ধর্মমঙ্গলের প্রসিদ্ধ / শ্রেষ্ঠ কবি ঘনরাম চক্রবর্তী ।
2. ঘনরাম চক্রবর্তীর নিবাস বর্ধমান জেলার কৃষ্ণপুর গ্রাম ।
3. কবি ‘ঢেকুর’ পালায় নিজের আত্ম পরিচয় দিয়েছেন ।
4. ঘনরাম চক্রবর্তীর পিতার নাম গৌরিকান্ত চক্রবর্তী । মাতার নাম সীতা (সুকুমার সেনের মতে, মহাদেবী) ।
5. সপ্তদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে কবি বর্তমান ছিলেন ।
6. ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্যের নাম ‘অনাদিমঙ্গল’ ।
7. ঘনরাম চক্রবর্তী বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচন্দ্র রায়ের আদেশে কাব্য রচনা করেন ।
8. ঘনরাম চক্রবর্তী অষ্টাদশ শতকের প্রথম ভাগে ধর্মমঙ্গল কাব্য রচনা করেন ।
9. ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্যের নাম পাওয়া যায় ‘শ্রীধর্মসঙ্গীত’, ‘মধুরভারতী’ ।
10. ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্যটি কাব্যটি ২৪টি সর্গে বিভক্ত ।
11. ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্যটিতে ৯১৪৭টি শ্লোক রয়েছে ।
12. ঘনরাম চক্রবর্তীর কাব্যের সমাপ্তিকাল ১৬৩৩ শকাব্দ অর্থাৎ ১৭১১ খ্রিষ্টাব্দ ।
13. কবির শিক্ষাগুরু কবি প্রতিভার জন্য তাকে ‘কবিরত্ন’ উপাধিতে ভুষিত করেন ।
14. ঘনরাম চক্রবর্তী ‘সত্যনারায়নের পাঁচালী’ রচনা করেছিলেন বলে মনে করা হয় ।
15. ঘনরাম চক্রবর্তীর ‘অনাদিমঙ্গল’ কাব্যের খল চরিত্র মহামদ ।
16. চরিত্র পরিচয়ঃ রঞ্জাবতী --- দেবনর্তকী জাম্ববতী ।

No comments