কাশীরাম সম্বন্ধে মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্তুতি প্রসঙ্গে জানিয়েছেন— ‘‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান। হে কাশী, কবীশ দলে তুমি পুণ্যবান।।” –কাশীরাম সম...
কাশীরাম সম্বন্ধে মাইকেল মধুসূদন দত্ত স্তুতি প্রসঙ্গে জানিয়েছেন—
‘‘মহাভারতের কথা অমৃত সমান।হে কাশী, কবীশ দলে তুমি পুণ্যবান।।”
–কাশীরাম সম্বন্ধে এই উক্তি সার্থক। কেননা কাশীরাম দাস তাঁর ‘ভারত পাঁচালী’র মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে তাদের হৃদয়ের সামগ্রীর দ্বারা পুণ্যফল বিতরণ করেছেন। সমগ্র বাঙালি জাতির হৃদয়, সামাজিক আদর্শ ও নীতি কর্তব্যকে কৃত্তিবাস ছাড়া আর কোন কবি এমনভাবে ব্যক্ত করতে পারেন নি। সপ্তদশ শতাব্দীতে রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতের যে সমস্ত ভাবানুবাদ হয়েছিল, তার মধ্যে কাশীদাস-ই শ্রেষ্ঠ অনুবাদক।
কবির ব্যক্তি পরিচয়ঃ
কাশীরামের নিজের দেওয়া তথ্য এবং অন্যান্য তথ্যাদি থেকে তাঁর ব্যক্তি পরিচয় জানা যায়। কাশীরাম দাসের জন্ম বর্ধমানের ইন্দ্রানী পরগণার অন্তর্গত সিঙ্গি (সিদ্ধি) গ্রামে, কায়স্থ বংশে। কাশীরামের পিতার নাম কমলাকাস্ত। কোন কোন পুঁথিতে তিনি এভাবে আপরিচয় দিয়েছেন—
‘‘ইন্দ্রানী নামেতে দেশ পূর্বাপর স্থিতি।দ্বাদশ তীর্থেতে যথা বৈসে ভাগীরথী৷৷কায়স্থ কুলেতে জন্ম বাস সিঙ্গি গ্রাম।প্রিয়ঙ্কর দাস পুত্র সুধাকর নাম।।তৎপুত্র কমলাকান্ত কৃষ্ণদাস পিতা।কৃষ্ণদাসানুজ গদাধর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।।পাঁচালি প্রকাশি কহে কাশীরাম দাস।অলি হব কৃষ্ণ পদে মনে অভিলাষ।।’’
দাস পদবী ব্যবহারের কারণঃ
কাশীরামের পদবী ছিল ‘দেব’। বিনয়বশত ‘দেব’ এর স্থলে তিনি ‘দাস’ ব্যবহার করেছেন । এছাড়া ধর্মবিশ্বাসে কাশীরাম ছিলেন বৈষ্ণবভাবাপন্ন।
কাব্য পরিচয়ঃ
কাশীরাম দাসের কাব্যের নাম ‘ভারত পাঁচালী’ ।
কাব্য সম্পর্কে তথ্যঃ
কাশীরাম দাস মহাভারতের আদি, সভা, বন, বিরাট - এ্ই ৪টি পর্ব অনুবাদ করেন । তারপর তিনি মারা যান । পুত্র, ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা বাকি ১৪টি পর্ব সমাপ্ত করেন । ১৮৬৬ সালে কালিপ্রসন্ন সিংহ প্রকাশিত মূল মহাভারতে এই সংক্রান্ত একটি শ্লোক পাওয়া যায় । শ্লোকটি হলঃ
‘‘ আদি সভা বন বিরাটের কতদুর ।ইহা রচি কাশীদাস গেল স্বর্গপুর ।।”
কাব্য রচনার প্রেরণাঃ
কাশীরাম তাঁর গুরুদেব অভিরাম মুখুটির আশীর্বাদে মহাভারত অনুবাদ করেন । শোনা যায় মেদিনীপুর জেলার আওসগড়ের মতান্তরে আলিগড়ের জমিদার বাড়িতে শিক্ষকতা করবার সময় বহু কথক ও পণ্ডিতের মুখে মহাভারত আখ্যান শুনে তাঁর মনে অনুবাদ কর্মের বাসনা জাগে |
কাব্য রচনাকালঃ
প্রাপ্ত পুঁথি অনুযায়ী কাশীরামের কাব্যের রচনাকাল নিয়ে পণ্ডিতমহলে মতভেদ রয়েছে। কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্ষিত পুঁথি অনুসারে এর রচনাকাল ১৫৯৫ খ্রিস্টাব্দ। তবে এ ব্যাপারে কোন সঠিক তথ্য না থাকায় ধরে নেওয়া হয় কবি সপ্তদশ শতকের প্রথম দিকে এই বৃহৎ গ্রন্থ রচনা করেন। তাছাড়া কাশীদাশী মহাভারত নামে প্রচলিত গ্রন্থটিকে সম্পূর্ণ তার লেখা তা নিয়েও সন্দেহ আছে। প্রবাদ আছে আদি, সভা, বন এবং বিরাট পর্ব রচনার পর তিনি লোকান্তরিত হন। তারপর কবির ভ্রাতুষ্পুত্র নন্দরাম কিছু অংশ লেখেন। শান্তি পর্বের লেখক কৃষ্ণানন্দ বসু এবং স্বর্গারোহন পর্ব জয়ন্তদাসের লেখা। জয়ন্তদাসকে কবির পুত্র বলে কেউকেউমনে করেছেন (তবে এ তথ্য যে সঠিক একথা বলা যায়না)।
গ্রন্থ রচনা নিয়ে কয়েকটি তথ্য—
“চন্দ্ৰ বান পক্ষ ঋতু শক সুনিশ্চয়।বিরাট হইল সাল কাশীদাস কয়।। "
----- চন্দ্র = ১. বান= ২, পক্ষ = ৩ ঋতু=8 অর্থাৎ ১৫২৬ শকাব্দ বা ১৬০৪-০৫ খ্রিস্টাব্দ।
কাব্য প্রকাশকালঃ
কাশীরাম দাসের মহাভারত ১৮০৩ খ্রিঃ শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে মুদ্রিত হয় । ‘ভারত পাঁচালী’র দ্বিতীয় সংস্করন প্রকাশিত হয় জয়গোপাল তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় ১৮৩৬ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামপুর মিশন থেকে ।
কাশীদাসী মহাভারতের বৈশিষ্ট্যঃ
কাশীরাম দাস সংস্কৃত ভাষায় অভিজ্ঞ ছিলেন। তাই তাঁর রচনা সংস্কৃত প্রভাবিত। মহাভারতে প্রচুর তৎসম শব্দ ও সমাসবদ্ধ পদের প্রয়োগ ঘটেছে। অলংকারের আতিশয্যে কোথাও রচনা কৃত্রিমতায় পর্যবসিত হয়ছে। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বিচার করলে রচনা সাবলীল গতিযুক্ত ও রসোত্তীর্ণ। তাঁর ভাষারীতিতে ক্লাসিক তৎসম শব্দের গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে।
কাশীরাম দাসের কৃতিত্বঃ
কাশীরাম দাস তাঁর রচনাকে ঘটনাবিন্যাসে, নাটকীয়তায়, সরস উক্তি-প্রত্যুক্তি ও হাস্যরস পরিবেশনে চিত্তাকর্ষী করে তুলেছেন। মহাভারতীয় রস ও ধ্বনিঝংকার অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য অনুবাদ কর্মে তিনি প্রয়াসী হন। কাশীদাসি মহাভারত মূলানুগ ও সংস্কৃতগন্ধী হলেও তা দুর্বোধ্য ও নীরস হয়ে ওঠেনি।
‘কাশীদাসী মহাভারত সামগ্রিকভাবে বাঙালী ঘরের কাহিনী হয়ে ওঠেনি’ - আলোচনাঃ
কাশীরাম দাস তাঁর মহাভারতে পৌরাণিক পরিমণ্ডল সৃষ্টি করতে প্রয়াসী হন। তাঁর রচনারীতিতে সংস্কৃত মহাভারতের তৎসমবহুল ক্লাসিক রীতির শব্দপ্রয়োগ বেশি। তাই কৃত্তিবাসি রামায়ণের মতো কাশীদাসি মহাভারত সামগ্রিকভাবে বাঙালি ঘরের কাহিনি হয়ে ওঠেনি। তবে একথা স্বীকার্য যে বাঙালি চরিত্রের অনুগ করেই তিনি মহাভারতকে সহজবোধ্য ও সাবলীল করে তোলেন।
কাব্যের ভক্তি ভাবুকতাঃ
চৈতন্যোত্তর যুগের প্রেমভক্তির আদর্শ কবির জীবনে প্রভাব বিস্তার করে। কাব্যে ভক্তিভাবুকতার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে স্বয়ম্বর সভায় অর্জুনের সৌন্দর্য বর্ণনার মধ্যে। অর্জুনের লক্ষ্যভেদের যোগ্যতা বোঝাতে গিয়ে কবি তাঁর ক্ষাত্রজনোচিত চরিত্রধর্ম ও শারীরিক সৌন্দর্যকে অনুপম ভাষায় ও অনুপ্রাসের ঝংকারে এক বর্ণদীপ্ত ভাবগাম্ভীর্যের শিল্পমূর্তি দান করেছেন। সেখানে বীরযোদ্ধা অর্জুন নবঘনশ্যামের মোহনমূর্তিতে রূপান্তরিত।
কাব্যে বাঙালীয়ানার পরিচয়ঃ
কাশীদাসি মহাভারত বাঙালিকে জীবনযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার বিপুল শক্তি ও অনুপ্রেরণা দেয়। কৃত্তিবাসের রামায়ণের মতো এই গ্রন্থ কেবলমাত্র করুণরসের নির্ঝর নয়। বাঙালির ধ্যান-ধারণা ও ভাবকল্পনার সঙ্গে কাশীরাম দাস মহাভারতীয় ভাবাদর্শকে যথাসম্ভব মিলিয়ে দিয়েছেন। সভ্যতার রূপবদলের তালে তালে বাঙালি জীবনেও কত পরিবর্তন হয়ে গেল। কিন্তু কাশীদাসি মহাভারতের কাব্যরসধারা অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার ন্যায় বাঙালির অন্তর্জীবনে কুলুকুলু নাদে প্রবাহিত। কাশীদাসি মহাভারত বাঙালির জীবনগীতা— একটি বড়ো ট্র্যাডিশন বা ঐতিহ্য।
এক নজরে কাশীরাম দাস |
1. বাংলা মহাভারতের শ্রেষ্ঠ অনুবাদক কাশীরাম দাস ।
2. কাশীরাম দাস সপ্তদশ শতকের কবি ।
30 কাশীরাম দাসের পৈত্রিক উপাধি ছিল দেব ।
4. কাশীরাম দাস বৈষ্ণব বংশোদ্ভূত ছিলেন, তাই বৈষ্ণবীয় বিনয় বশত দাস ব্যবহার করেছেন ।
5. বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহাকুমার অন্তর্গত সিঙ্গি গ্রামে কাশীরাম দাস জন্মগ্রহন করেন ।
6. কবি জাতিতে ছিলেন কায়স্থ ।
7. কাশীরামের পিতার নাম কমলাকান্ত ।
8. কমলাকান্তের তিন পুত্র - কৃষ্ণ , কাশীরাম, গদাধর ।
9. কাশীরাম দাসের গুরুর নাম অভিরাম মুখুটি ।
10. কাশীরাম দাস ব্যাসদেবের মহাভারতের অনুবাদ করেন ।
11. কাশীরাম দাসের মহাভারতের নাম ‘ভারত পাঁচালী’ ।
12. ষোড়শ শতকের শেষে অথবা সপ্তদশ শতকের শুরুতে কাশীরাম দাস মহাভারত অনুবাদ করেন ।
13. কাশীরাম দাস অভিরাম মুখুটির আর্শিবাদে ও নির্দেশে মহাভারত রচনা করেন ।
14. কাশীরাম দাসের মহাভারতে ১৮ টি পর্ব আছে ।
15. কাশীরাম দাসের মহাভারত ১৮০৩ খ্রিঃ শ্রীরামপুর মিশন প্রেস থেকে মুদ্রিত হয় ।
16. কাশীরাম দাসের মহাভারতের মৌলিক উপাখ্যান ‘শ্রীবৎস কাহিনী’ ।
17. কাশীরাম দাস মূল মহাভারতের আক্ষরিক অনুবাদ করেন নি, ভাবানুবাদ করেছেন ।
18. মাইকেল মধুসূদন দত্ত কাশীরাম দাস সম্পর্কে বলেছেনঃ
‘‘ মহাভারতের কথা অমৃত সমান ।
হে কাশী কবীশ দলে তুমি পুণ্যবান ।।”
19. ১৫২৬ শকে । অর্থাৎ (১৫২৬+৭৮) = ১৬০৪ - ০৫ খ্রিষ্টাব্দে এই কাব্য রচিত হয় ।
২0. কাশীরাম দাসের মহাভারতের ‘বন’ পর্বের অসম্পূর্ন অংশ রচনা করেন জিৎ ঘটক ।

No comments