“একটা পার্বত্য পাগলাঝোরার ধারার ন্যায় অনিয়ন্ত্রিত কল্পনা এবং হৃদয়াবেগের প্রাচুর্য লইয়া বাঙলা-সাহিত্যে আবির্ভাব হইয়াছিল কবি নবীনচন্দ্রের...
“একটা পার্বত্য পাগলাঝোরার ধারার ন্যায় অনিয়ন্ত্রিত কল্পনা এবং হৃদয়াবেগের প্রাচুর্য লইয়া বাঙলা-সাহিত্যে আবির্ভাব হইয়াছিল কবি নবীনচন্দ্রের।”
---- নবীনচন্দ্র সম্পর্কে শশিভূষণ দাশগুপ্তের এই মন্তব্যটি যথাযথ এই কারণে যে, নবীনচন্দ্রের প্রতিভা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বতন্ত্র এবং তিনি কোন কবির মন্ত্রশিষ্য ছিলেন না। মহাকাব্য রচনায় আত্মনিয়োগ করলেও নবীনচন্দ্রের কবিপ্রতিভা ছিল গীতিকবির। যদিও তিনি আখ্যান কাব্য, মহাকাব্য, খণ্ডকাব্য প্রভৃতি রীতির কাব্য রচনা করেছিলেন, তবুও তার প্রতিভার মধ্যে ছিল উচ্ছ্বাস ও ভাবুকতাসুলভ এক কবি মন।
পরিচয় :
আধুনিক বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার নওয়াপাড়া গ্রামে নবীনচন্দ্র জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাল্য ও কৈশোর কাটে চট্টগ্রামে। সেখান থেকে বৃত্তি সমেত প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতায় এসে পড়াশোনা শুরু করেন। কলেজে পড়ার সময় তার কিছু কিছু কবিতা ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের 'এডুকেশন গেজেট' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ১৮৬৭ সালে জেনারেল এ্যাসেমব্লিজ ইনস্টিটিউশন থেকে বি.এ. পাশ করেন। কর্মজীবন শুরু করেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁকে 'বাংলার বায়রণ' বলেছিলেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি মারা যান।
রচনাবলী :
- নবীনচন্দ্রের প্রথম কাব্য ‘অবকাশরঞ্জিনী'।
প্রথম রচনা :
- নবীনচন্দ্রের প্রথম কাব্য ‘অবকাশরঞ্জিনী'।
কাব্যগ্রন্থ :
নবীনচন্দ্র সেন রচিত কাব্যগ্রন্থগুলি হল :
- 'অবকাশরঞ্জিনী' (১ম - ১৮৭১, ২য় - ১৮৭৮),
- ‘পলাশীর যুদ্ধ' (১৮৭৫),
- 'ক্লিওপেট্রা' (১৮৭৭),
- 'রঙ্গমতী' (১৮৮০),
- 'খ্রীষ্ট' (১৮৯১),
- ‘অমিতাভ’ (১৮৯৫),
- ‘অমৃতাভ’ (১৯০৯),
- 'রৈবতক'(১৮৮৭),
- 'কুরুক্ষেত্র’ (১৮৯৩),
- ‘প্রভাস’ (১৮৯৬)।
'ত্রয়ী' কাব্য :
- 'রৈবতক'-১৮৮৭,
- 'কুরুক্ষেত্র’-১৮৯৩,
- ‘প্রভাস’-১৮৯৬।
উপন্যাস :
- ‘ভানুমতী’
আত্মজীবনী :
- ‘আমার জীবন ( পাঁচখণ্ডে রচিত ’ আত্মজীবনীমূলক রচনা )
আলোচনা :
(১) ‘অবকাশরঞ্জিনী’ :
- নবীনচন্দ্রের প্রথম কাব্য ‘অবকাশরঞ্জিনী'।
- এর প্রথম ভাগে বাইশটি এবং দ্বিতীয় ভাগে তেতাল্লিশটি কবিতা রয়েছে।
- বেশিরভাগ কবিতায় রোমান্টিক প্রেমের হতাশার সুর ধ্বনিত হয়েছে।
- প্রেম, প্রকৃতি, স্বদেশ, গৃহজীবন এই বিষয়গুলি হল কাব্যের প্রধান বিষয়।
- এগুলি মূলত গীতিকবিতা ।
(২) ‘পলাশীর যুদ্ধ’ :
- নবীনচন্দ্রের ‘পলাশীর যুদ্ধ' কাব্য উল্লেখযোগ্য।
- পাঁচ সর্গে রচিত এটি একটি দেশপ্রেমমূলক আখ্যান কাব্য।
- বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলার ভাগ্য বিপর্যয়ের কাহিনি অবলম্বনে পরাধীনতার বেদনাকে কবি এই কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন।
(৩) ‘ক্লিওপেট্টা’’ :
- পলাশীর যুদ্ধের পর ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে 'ক্লিওপেট্রা' প্রকাশিত হয়।
- এটি একটি প্রেমমূলক রোমান্টিক কাব্য।
(৪) ‘রঙ্গমতী’ :
- ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ‘রঙ্গমতী'।
- এটি এক কাল্পনিক স্বদেশপ্রেমমূলক রোমান্টিক কাব্য।
- কাব্যের নায়ক বীরেন্দ্রের জন্মভূমি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি, তাই এই নামকরণ।
- এই কাব্যের কল্পনা সংযত নয়, স্বদেশপ্রেমও উচ্ছ্বাসমাত্র।
- কাব্যটি অমিত্রাক্ষর ছন্দে লেখা।
palas
(৫) ‘ত্রয়ী কাব্য’ :
- ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাকাব্যের ধারায় নবীনচন্দ্রের শেষ কাব্য ‘ত্রয়ী’৷
- ‘রৈবতক’ (১৮৮৭), ‘কুরুক্ষেত্র’ (১৮৯৩) এবং ‘প্রভাস’ (১৮৯৬)– এই তিনটি কাব্য একসঙ্গে ‘ত্রয়ী’ নামে পরিচিত।
- প্রধানত কৃষ্ণের জীবনকথাই এই কাব্যের বিষয়বস্তু।
- বঙ্কিমচন্দ্রের মতে এই তিনটি কাব্য ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাভারত’ (‘Mahavarata of the Nineteenth Century')।
- নবীনচন্দ্র ঊনবিংশ শতাব্দীর যুরোপীয় সমাজদর্শন, জ্ঞানবিজ্ঞান ও নীতিতত্ত্বের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষ্ণের মাধ্যমে নতুন মানবধর্ম প্রচার করতে চেয়েছিলেন।
- ‘রৈবতক’ কুড়িটি সর্গে, 'কুরুক্ষেত্র’ সতেরটি সর্গে এবং ‘প্রভাস’ তেরটি সর্গে রচিত।
- ‘ত্রয়ী’ কাব্যের পরিকল্পনা সম্বন্ধে ‘প্রভাসে’র উৎসর্গ পত্রে কবি লিখেছিলেন,
“রৈবতক কাব্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আদি-লীলা, কুরুক্ষেত্র কাব্য মধ্য-লীলা এবং প্রভাস কাব্য অস্তিম-লীলা লইয়া রচিত। রৈবতকে কাব্যের উন্মেষ, কুরুক্ষেত্রে বিকাশ এবং প্রভাসে শেষ।”

No comments