রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতার ধারায় যেসব কবির নাম অনিবার্যভাবে উঠে আসে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সুভাষ মুখােপাধ্যায়। তিনি যে-সময়ে কবিতা র...
রবীন্দ্র-পরবর্তী বাংলা কবিতার ধারায় যেসব কবির নাম অনিবার্যভাবে উঠে আসে, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন সুভাষ মুখােপাধ্যায়। তিনি যে-সময়ে কবিতা রচনা শুরু করেন তখন বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের প্রভাব ছাড়াও ছিল নজরুল ইসলামের প্রভাব। কিন্তু তিনি প্রথম থেকেই ছিলেন বিশিষ্ট। তিনি অনায়াসে সমস্ত প্রভাব থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে নিজস্ব ভঙ্গিতে কথা বলতে পেরেছিলেন। বাংলা কাব্যজগতে আবির্ভাবের সময়েই তিনি জানিয়ে দিতে পেরেছিলেন, তিনি আর পাঁচজনের মতাে নন, তিনি অনন্য, তিনি হাজির হয়েছেন অনেক অনেক সম্ভাবনা নিয়ে। আবির্ভাব-লগ্নেই তিনি বুঝিয়ে দিতে পেরেছিলেন তাঁর কবিতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া অসম্ভব।
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের জন্ম অধুনা পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে মামাবাড়িতে। তার পিতার নাম ক্ষিতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, মা যামিনী দেবী। প্রথমে নওগাঁর স্কুলে এবং পরে কলকাতার মেট্রোপলিটান ইনস্টিটিউশন ও সত্যভামা ইনস্টিটিউশনে পড়াশোনা করেন। ভবানীপুরের মিত্র স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করে সক্রিয় রাজনীতি করার মানসে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। ১৯৪১ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে দর্শনে অনার্স-সহ বিএ পাস করেন। পরে আশুতোষ কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নে প্রয়াসী হন। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার ফলে পঠনপাঠন বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘোষিত হলে বহু কমিউনিস্ট বন্দীর সঙ্গে দু-বার কারাবরণ করেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় । মুক্তির পর কবির জীবনে দেখা দেয় প্রচণ্ড অর্থকষ্ট। একটি নতুন প্রকাশন সংস্থায় মাত্র ৭৫ টাকা বেতনে সাব-এডিটর নিযুক্ত হন তিনি। যকৃৎ ও হৃদপিণ্ডের অসুস্থতার কারণে দীর্ঘকাল রোগভোগের পর ২০০৩ সালে কলকাতায় তার জীবনাবসান ঘটে।
প্রথম রচনা :
(a) সুভাষ মুখোপাধ্যাবের প্রথম প্রকাশিত লেখা 'কথিকা' ১৯৩৩-৩৪ খ্রিস্টাব্দে সভ্যভামা ইনস্টিটিউশনের স্কুল ম্যাগাজিন 'ফল্গু’ তে প্রকাশিত।
(b) প্রথম কাব্যগ্রন্থ “পদাতিক” প্রকাশিত হয় কবিতা ভবন থেকে ১১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ।
(c) প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ “আমার বাংলা" (১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত)।
(d) প্রথম প্রেমের কবিতা - "মিছিলের মুখ" ।
কাব্যগ্রন্থ :
- ‘পদাতিক’ (১৯৪০),
- ‘অগ্নিকোণ’ (১৯৪৮),
- ‘চিরকুট ’(১৯৫০),
- ‘ফুল ফুটুক’ (১৯৫৭),
- ‘যত দূরেই যাই’ (১৯৬২),
- ‘কাল মধুমাস’ (১৯৬৬),
- ‘এই ভাই’ (১৯৭১),
- ‘ছেলে গেছে বনে’ (১৯৭২),
- ‘একটু পা চালিয়ে ভাই’ (১৯৭৯),
- ‘জল সইতে’ (১৯৮১),
- ‘চইচই চইচই ’(১৯৮৩),
- ‘বাঘ ডেকেছিল’ (১৯৮৫),
- ‘যা রে কাগজের নৌকা’ (১৯৮৯),
- ‘ধর্মের কল’ (১৯৯১),
- একবার বিদায় দে মা’ (১৯৯৫),
- ‘ছড়ানো মাটি’ (২০০১)।
কবিতা সংকলন :
- ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কবিতা’ (১৩৬৪ বঙ্গাব্দ),
- ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ (১৯৭০),
- ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য সংগ্রহ, প্রথম খণ্ড’ (১৩৭৯ বঙ্গাব্দ),
- ‘সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কাব্য সংগ্রহ, দ্বিতীয় খণ্ড’ (১৩৮১ বঙ্গাব্দ),
- ‘কবিতা সংগ্রহ ১ম খণ্ড’ (১৯৯২),
- ‘কবিতা সংগ্রহ ২য় খণ্ড’ (১৯৯৩),
- ‘কবিতা সংগ্রহ ৩য় খণ্ড’ (১৯৯৪),
- ‘কবিতা সংগ্রহ ৪র্থ খণ্ড’ (১৯৯৪)।
অনুবাদ কবিতা :
- ‘নাজিম হিকমতের কবিতা’ (১৯৫২),
- ‘দিন আসবে’ (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ - নিকোলো ভাপৎসারভের কবিতা),
- ‘পাবলো নেরুদার কবিতাগুচ্ছ’ (১৩৮০ বঙ্গাব্দ),
- ‘ওলঝাস সুলেমেনভ-এর রোগা ঈগল’ (১৯৮১ বঙ্গাব্দ),
- ‘নাজিম হিকমতের আরো কবিতা’ (১৩৮৬ বঙ্গাব্দ),
- ‘পাবলো নেরুদার আরো কবিতা’ (১৩৮৭ বঙ্গাব্দ),
- ‘হাফিজের কবিতা’ (১৯৮৬),
- ‘চর্যাপদ’ (১৯৮৬),
- ‘অমরুশতক’ (১৯৮৮)।
ছড়া :
- ‘মিউ-এর জন্য ছড়ানো ছিটানো’ (১৯৮০)।
কবিতা সম্পর্কিত গদ্যরচনা :
- ‘কবিতার বোঝাপড়া’,
- ‘টানাপোড়েনের মাঝখানে’।
রিপোর্টাজ ও ভ্রমণসাহিত্য :
- ‘আমার বাংলা’ (১৯৫১),
- ‘যেখানে যখন’ (১৩৬৭ বঙ্গাব্দ),
- ‘ডাকবাংলার ডায়েরী’ (১৯৬৫),
- ‘নারদের ডায়েরী’ (১৩৭৬ বঙ্গাব্দ),
- ‘যেতে যেতে দেখা’(১৩৭৬ বঙ্গাব্দ),
- ‘ক্ষমা নেই’ (১৩৭৮ বঙ্গাব্দ),
- ‘ভিয়েতনামে কিছুদিন’ (১৯৭৪),
- ‘আবার ডাকবাংলার ডাকে’ (১৯৮৪),
- ‘টো টো কোম্পানী’ (১৯৮৪),
- ‘এখন এখানে’ (১৯৮৬),
- ‘খোলা হাতে খোলা মনে’ (১৯৮৭)।
অর্থনৈতিক রচনা :
- ‘ভূতের বেগার’ (১৯৫৪) - কার্ল মার্ক্স রচিত ওয়েজ লেবার অ্যান্ড ক্যাপিটাল অবলম্বনে রচিত।
অনুবাদ রচনা :
- ‘মৃত্যুক্ষুধা’ (১৯৫৩ ) - ভবানী ভট্টাচার্যের সো মেনি হাঙ্গার্স উপন্যাসের অনুবাদ ,
- ‘রোজেনবার্গ পত্রগুচ্ছ’ (১৯৫৪),
- ব্যাঘ্রকেতন (নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জীবনভিত্তিক একটি অনুবাদ),
- ‘রুশ গল্প সঞ্চয়ন’ (১৯৬৮),
- ‘ইভান দেনিসোভিচের জীবনের একদিন’ (১৯৬৮),
- ‘চে গেভারার ডায়েরী’ (১৯৭৭),
- ‘ডোরাকাটার অভিসারে’ (১৯৬৯) - শের জঙ্গের ট্রায়াস্ট উইথ টাইগার্স অবলম্বনে রচিত,
- ‘আনাফ্রাঙ্কের ডায়েরী’ (১৯৮২),
- ‘তমস (১৩৯৫ বঙ্গাব্দ, ভীষ্ম সাহানীর উপন্যাসের অনুবাদ)।
an style="background-color: #2b00fe; font-family: Galada;"> উপন্যাস :
- ‘হাংরাস’ (১৯৭৩),
- ‘কে কোথায় যায়’ (১৯৭৬),
- ‘চিঠির দর্পণে’।
জীবনী :
- ‘জগদীশচন্দ্র’ (১৯৭৮),
- ‘আমাদের সবার আপন ঢোলগোবিন্দের আত্মদর্শন’ (১৯৮৭),
- ‘ঢোলগোবিন্দের এই ছিল মনে’।
শিশু ও কিশোর সাহিত্য :
- ‘বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থের কিশোর সংস্করণ’ (১৯৫২) - এটি ‘নীহাররঞ্জন রায় রচনা করেন ।
- ‘অক্ষরে অক্ষরে আদি পর্ব (১৯৫৪),
- ‘কথার কথা’ (১৯৫৫),
- ‘দেশবিদেশের রূপকথা’ (১৯৫৫),
- ‘বাংলা সাহিত্যের সেকাল ও একাল’ (১৯৬৭),
- ‘ইয়াসিনের কলকাতা’ (১৯৭৮)।
সম্পাদিত গ্রন্থ :
- ‘কেন লিখি’ (১৯৪৫) - এটি বিশিষ্ট বাঙালি সাহিত্যিকদের জবানবন্দী । হিরণকুমার সান্যালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রচিত),
- ‘একসূত্র’ (১৯৫৫) - এটি ফ্যাসিবিরোধী কবিতা সংকলন। সুভাষ মুখোপাধ্যায় গোলাম কুদ্দুসের সঙ্গে যৌথ সম্পাদনা করেন।
- ‘ছোটদের পুজো সংকলন’ – পাতাবাহার,
- ‘বার্ষিক আগামী’ ইত্যাদি।
সংকলন :
- ‘গদ্যসংগ্রহ’ (১৯৯৪) ।
সম্মাননা :
- সাহিত্য অকাদেমী পুরস্কার (১৯৬৪ সালে);
- অ্যাফ্রো-এশিয়ান লোটাস প্রাইজ (১৯৭৭);
- কুমারন আসান পুরস্কার (১৯৮২);
- সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রদত্ত মির্জো টারসান জেড পুরস্কার (১৯৮২);
- আনন্দ পুরস্কার (১৯৮৪) ,
- ভারতীয় জ্ঞানপীঠ পুরস্কার (১৯৯২)।
- ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা সাহিত্য অকাদেমী ফেলোশিপ পান (১৯৯৬) ।
- বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাপ্ত সর্বোচ্চ সম্মান দেশিকোত্তম ।
কাব্য আলোচনা :
(a) ‘পদাতিক’ :
- ১৯৪০ সালে একুশ বছর বয়সে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘পদাতিক’ যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।
- গ্রন্থের কবিতাগুলো লেখা হয়েছে–১৯৩৮ থেকে ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে।
- সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম কাব্যগ্রন্থ - ‘পদাতিক’ ।
- এই কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতা ‘পদাতিক’ ।
বাংলা কাব্যসাহিত্যে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের অপরিসীম অবদান আছে।
১। তাঁর কবিতায় সাম্যবাদী চিন্তা বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনি ‘পদাতিক' কবি নামে পরিচিত হয়ে আছেন।
২। যেখানে অন্যায় দেখেছেন, সেখানেই তিনি প্রতিবাদ করেছেন ।
৩। তথাকথিত রোমান্টিকতাকে তিনি বারে বারে ব্যঙ্গবানে বিদ্ধ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বধূ'কে চাঁদকে নিয়ে যাঁরা রোমান্টিক স্বপ্ন রচনা করেছেন, সেইসব রোমান্টিক কবিদের বিরোধিতা করেছেন ।
৪। সামাজিক দুঃখ যন্ত্রণাকে তিনি প্রায়ই কবিতার বিষয় করেছেন। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার গণঅভ্যুত্থানকে কাব্যে রূপায়িত করেছেন ‘অগ্নিকোণ’ কবিতায়। ক্ষুধার্ত মানুষদের গর্জন শোনা গেছে ‘চিরকূট’ কবিতায় ।
৫। তাঁর কবিতার বাচনভঙ্গি সহজ, সরল ও সাধারণ, প্রচলিত ভাষা, শব্দ, বাগবিধিকে তিনি স্বচ্ছন্দে এবং সহজভাবে ব্যবহার করেছেন।

No comments