রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে যে তিন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আবির্ভাব হয়েছিল তা বাংলা সাহিত্যের জগতে নতুন যুগের সম্ভবনা সূচিত করেছিল -- তাদের মধ্যে বয়োজ্...
বিভূতিভূষণ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার মুরাতিপুর গ্রামে মামার বাড়িতে। তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার বনগাঁ'র নিকটবর্তী বারাকপুর গ্রামে। বিভূতিভূষণের পিতা মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন একজন বিখ্যাত সংস্কৃত পন্ডিত। তিনি এই পান্ডিত্যের জন্য শাস্ত্রী উপাধি পেয়েছিলেন। বিভূতিভূষণের মাতা হলেন মৃণালিনী দেবী। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন স্কুলের শিক্ষক অর্থাৎ তিনি শিক্ষকতার মধ্যে দিয়ে পেশাগত জীবনে প্রবেশ করেন। বিভূতিভূষণের খ্যাতি বাংলা উপন্যাসের পাশাপাশি বাংলা ছোট গল্পেও। বিভূতিভূষণের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি 'পথের পাঁচালী'। সেটি 'বিচিত্রা' পত্রিকায় প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই বহু কৌতুহলী পাঠক এটার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পরে 'পথের পাঁচালী'র উত্তরকান্ড হিসেবে 'অপরাজিতা' উপন্যাসটি 'প্রবাসী' পত্রিকায় (১৩৩৬-৩৮) বহুদিন ধরে প্রকাশিত হয়েছে। বিভূতিভূষণের এই সুপ্রসিদ্ধ উপন্যাস গুলির রসাস্বাদন করে পাঠক ও সমালোচক অনুভব করতে পারেন যে বাংলা উপন্যাসের মহাকাশে এক নতুন নক্ষত্রের উদয় হয়েছে। এরপর বিভূতিভূষণ তাঁর অনেকগুলি স্নিগ্ধ মধুর ছোট গল্পের রচনার মাধ্যমে পাঠকের হৃদয় স্পর্শ করেছেন। দুঃখ দারিদ্র্যের ছবি তিনি এঁকেছেন কিন্তু, সে ছবি কোনো সমাজ বা অর্থনীতি ঘটিত প্রখর প্রশ্ন উত্থাপন করেনা। কিছু কিছু প্রেমের চিত্রও এঁকেছেন কিন্তু তাতে রোমান্টিক ও বৈচিত্র্য ও উত্তপ্ত কামনার চেয়ে স্নিগ্ধ মধুর শান্ত ও গার্হস্থ রূপটি বেশি প্রকাশ পেয়েছে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ১লা নভেম্বর, ১৯৫০ সালে মৃত্যু বরণ করেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের গ্রন্থাবলীঃ
প্রথম রচনা :
(a) পাঁচুগোপাল বা যতীন্দ্রমোহন রায় নামে এক শিশু কবির জন্য বাধ্য হয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর প্রথম ছোটগল্প “উপেক্ষিতা” রচনার মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্য জগতে পদার্পণ করেন । গল্পটি প্রবাসী পত্রিকায় ১৩২৮ বঙ্গাব্দের মাঘ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় ।
(b) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় উপন্যাস “পথের পাঁচালী” উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকায় ১৩৩৫ বঙ্গাব্দের আষাঢ় সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয় ।
(c) বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ “মেঘমল্লার” ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয় ।
উপন্যাসঃ
- `পথের পাঁচালী' (১৯২৯)
- `অপরাজিতা' (১৯৩২)
- `দৃষ্টি প্রদীপ' (১৯৩৫)
- `আরণ্যক' (১৯৩৯)
- `আদর্শ হিন্দু হোটেল' (১৯৪০)
- `বিপিনের সংসার' (১৯৪১)
- ‘দউ বাড়ি’ (১৯৪১)
- ‘অনুবর্তন’ (১৯৪২)
- `দেবযান' (১৯৪৪)
- `কেদার রাজা' (১৯৪৫)
- `অথৈজল' (১৯৪৭)
- `ইছামতী' (১৯৫০)
- ‘দম্পতি’ (১৯৫২)
- ‘অশনি সংকেত’ (১৯৫৯)
- বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় “পথের পাঁচালী” এবং “অপরাজিত” উপন্যাসের শেষ পর্ব “কাজল” রচনার পরিকল্পনা করেছিলেন, এবং “কাজল কেন লিখব” নামে একটি ভূমিকা অংশ লেখক একটি পত্রিকায় রচনা করেন । কিন্তু ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি তা সমাপ্ত করতে পারেননি । পরবর্তী সময়ে তা সমাপ্ত করেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ।
গল্প সংকলনঃ
- `মেঘমল্লার' (১৯৩১)
- `মৌরিফুল' (১৯৩২)
- `যাত্রা বদল' (১৯৩৪)
- ‘জন্ম মৃত্যু’ (১৯৩৭)
- `কিন্নর দল' (১৯৩৮)
- ‘বেণীগীর ফুলবাড়ি’ (১৯৪১)
- ‘নবাগত’ (১৯৪৪)
- ‘উপলখন্ড’ (১৯৪৪)
- `তাল নবমী' (১৯৪৪)
- `বিধু মাস্টার' (১৯৪৫)
- ‘ক্ষনভঙ্গুর’ (১৯৪৫)
- `অসাধারণ' (১৯৪৬)
- ‘মুখোস ও মুখশ্রী’ (১৯৪৭)
- ‘নীলগঞ্জের ফালমন সাহেব’ (১৯৪৮)
- ‘জ্যোতিরিঙ্গন’ (১৯৪৯)
- ‘কুশল পাহাড়ি’ (১৯৫০)
- ‘রূপ হলুদ’ (১৯৫৭)
- ‘ছায়াছবি’ (১৯৬০)
- ‘অনুসন্ধান’ (১৯৬০)
কিশোর পাঠ্যঃ
- `চাঁদের পাহাড়' (১৯৩৮)
- `মরণের ডঙ্কাবাজে' (১৯৪০)
- `মিসমিদের কবচ' (১৯৪২)
- `হীরা মানিক জ্বলে' (১৯৪৬)
ভ্রমণ কাহিনী :
- `অভিযাত্রিক' (১৯৪০)
- `বনে পাহাড়ে' (১৯৪৫)
দিনলিপি :
- ‘স্মৃতির রেখা’ (১৯৪১)
- ‘তৃণাঙ্কুর’ (১৯৪৩) - আত্মজীবনীমূলক রচনা ।
- ‘উর্মিমুখর’ (১৯৪৪)
- ‘উৎকর্ণ’ (১৯৪৬)
- ‘হে অরণ্য কথা কও’ (১৯৪৮)
- ‘অন্তরঙ্গ দিনলিপি’ (১৯৭৬)
- ‘বিভূতিভূষণের অপ্রকাশিত দিনলিপি’ (১৯৮৩)
উৎসর্গীকৃত রচনা :
- “পথের পাঁচালী” – পিতৃদেব মহানন্দ বন্দ্যোপাধ্যায় ।
- “অপরাজিত” – মাতৃদেবী মৃণালিনী দেবী ।
- “চাঁদের পাহাড়” – খুকু ।
- “আরণ্যক” – প্রথম পত্নী গৌরী দেবী ।
- “আদর্শ হিন্দু হোটেল” – নটুবিহারী বন্দ্যোপাধ্যায় ।
- “বিপিনের সংসার” – চারুচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ।
- “দেবযান” – ষোড়শীকান্ত চট্টোপাধ্যায় ।
- “কেদার রাজা” – নীরদরঞ্জন দাশগুপ্ত ।
- “ইছামতী” – দ্বিতীয় পত্নী রমা দেবী ।
- “স্মৃতির রেখা” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি উদ্দেশ্যে ।
পত্রিকায় প্রকাশিত রচনা :
- “পথের পাঁচালী” – বিচিত্রা পত্রিকা ।
- “অপরাজিত” – প্রবাসী পত্রিকা ।
- “দৃষ্টিপ্রদীপ” – প্রবাসী পত্রিকা ।
- “আরণ্যক” – প্রবাসী পত্রিকা ।
- “আদর্শ হিন্দু হোটেল” – মাতৃভূমি পত্রিকা ।
- “কেদার রাজা” – মাতৃভূমি পত্রিকা ।
- “অথৈ জল' – প্রভাতী পত্রিকা ।
- “ইছামতি” – অভ্যুদয় পত্রিকা ।
- “চাঁদের পাহাড়” – মৌচাক পত্রিকা ।
- “মরণের ডঙ্কা বাজে” – মৌচাক পত্রিকা ।
- “পুঁইমাচা” – প্রবাসী পত্রিকা ।
- “মৌরীফুল” – প্রবাসী পত্রিকা ।
আলোচনা :
“পথের পাঁচালী” :
- উপন্যাস টি ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ।
- ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে ভাগলপুরে থাকার সময় উপন্যাস টি লিখতে শুরু করেন ।
- এই উপন্যাসের বীজ লুকিয়ে ছিল তাঁর রচিত “পুঁইমাচা” গল্পে ।
- রোমা রোলাঁর “Jean Christophe” -র সাথে এই উপন্যাসের মিল রয়েছে ।
- লেখক এই উপন্যাসের দুর্গা চরিত্রের পরিকল্পনা করেন ভাগলপুরের এক তরুণীকে দেখে ।
- চরিত্র -- অপু, দুর্গা, সর্বজয়া, হরিহর ।
“অপরাজিত” :
- “পথের পাঁচালী” উপন্যাস যেখানে শেষ সেখান থেকে এই উপন্যাস টি শুরু হয়েছে ।
- প্রবাসী পত্রিকায় উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
- ইসলামপুরের বনভূমি এবং ব্যারাকপুরের প্রাকৃতিক শোভায় মুগ্ধ হয়ে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এই উপন্যাস টি রচনা করেন।
“আরণ্যক” :
- অরণ্যই এই উপন্যাসের পটভূমি রচনা করেছে ।
- এই উপন্যাসে প্রকৃতি মুখ্য, মানুষ গৌণ ।
- ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে লেখক খোলাৎচন্দ্র ঘোষ কোম্পানির সহকারী ম্যানেজার রূপে ভাগলপুরে যান । এবং তাঁকে প্রায় দিয়া, ইসলামপুরের জঙ্গল পরিদর্শনে যেতে হত । তাঁর এই দিনগুলির কথায় এই উপন্যাসে ধরা পড়েছে ।
- চরিত্র -- সত্যচরণ, ভানুমতী, বুদ্ধু সিং, দোবরু পান্না, কুন্তা, মটুকনাথ ।
“ইছামতী” :
- ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় খোলাৎচন্দ্র ইন্সটিটিউশনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে সস্ত্রীক ব্যারাকপুর ফিরে আসেন ।
- ব্যারাকপুর গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত ইছামতী নদীর দুই তীরের মানুষজন এবং তাদের সমাজ জীবনের কাহিনী, নীলকুঠি ও নীলচাষ সংক্রান্ত নানা ঘটনার তরঙ্গ ভঙ্গে উপন্যাস টি রচিত ।
- এই উপন্যাসটির জন্য ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে মরনোত্তর রবীন্দ্র পুরস্কার পান ।
- চরিত্র --- রাজারাম, রামকানাই কবিরাজ, বিলু, নীলু, ভবানী বাড়ুজ্যে ।
কথাসাহিত্যে বিভূতিভূষণের জনপ্রিয়তার কারণ :
বিভূতিভূষণ বাংলাদেশের (এবং বাংলার বাইরের—'আরণ্যক') ভূপ্রকৃতির বুকে যে সমস্ত বালক, শিশু, যুবক বৃদ্ধের ছবি এঁকেছেন তার মূলরস হল রূপকথার রস। পরিচিত বিবর্ণ দেশকালের অস্তরে অপূর্ব কল্পলোকের রসবস্তু লুকিয়ে আছে, কঠোর বাস্তবের মধ্যেই একটি রূপলোকের স্বপ্নমাধুরী নিহিত রয়েছে। শিশুর মতো কৌতূহল এবং কবির মতো কল্পনার প্রলেপ দিয়ে বিভূতিভূষণের অননুকরণীয় ভাষায় এমন গ্রামীণ জীবনের চিত্র এঁকেছেন যে, চিত্র হিসেবে তা অনবদ্য এবং অনতিক্রমনীয়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্পীপ্রাণের বৈশিষ্ট্য :
বিভূতিভূষণ আস্বাদনপন্থী, বিশ্লেষণপন্থী নন। জীবনের ব্যাখ্যাতার ভূমিকা তিনি গ্রহণ করেননি, তিনি জীবনের উপভোক্তা। তারাশঙ্করের রুদ্রতা, মানিকের বিজ্ঞানবুদ্ধি বা প্রেমেন্দ্রের জীবনতৃষ্মা তাঁর মধ্যে নেই—কিন্তু এই তিনজনের মতোই জীবন এবং মানুষের প্রতি তাঁর অকৃপণ মমতা আছে। তাঁর সাহিত্যে একদিকে একটি সরল পল্লিপ্রাণ মানুষ যে সামাজিক, হৃদয়বান, পরদুঃখকাতর, সংযত ইন্দ্রিয়, অন্যদিকে একটি ঘরভোলা মুগ্ধদৃষ্টি কিশোর—যার চোখের সামনে প্রকৃতি প্রতিদিন নবনব রহস্যের যবনিকা উন্মোচিত করেছে।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে ঔপন্যাসিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় স্মরণীয়তা :
চিত্র, ঘটনা, অন্তর্দ্বন্দ্ব, তাত্ত্বিক সংঘাত, সামাজিক প্রশ্ন, বিভূতিভূষণের উপন্যাসে এসবের বিশেষ বাহুল্য নেই। আছে চেনা পৃথিবীর মধ্যে, পরিচিত মানুষের মধ্যে, দৈনন্দিন জীবনধারণের মধ্যে, অচেনা অরূপ জগতের মধ্যে সৌন্দর্যময় ইঙ্গিত, রহস্যময় ব্যঞ্জনা। সে দিক থেকে শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, বিশ্বসাহিত্যেও বিশেষ স্থান অধিকার করে আছেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাসকার না বলে পাঁচালিকার :
কোনো কোনো সমালোচকের মতে, অন্তর্দ্বন্দ্বমুখর ও মনস্তত্ত্ব-সংকুল কোনো সংঘাত সংঘর্ষ তাঁর উপন্যাসে নেই বলে, তিনি প্রকৃতই পাঁচালিকার, ঔপন্যাসিক নন। কিন্তু এ অভিমত কোনো দিক দিয়েই সমর্থনযোগ্য নয়। যাঁরা আধুনিক পাশ্চাত্য উপন্যাসের গতিপ্রকৃতির সন্ধান রাখেন, তাঁরা নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন যে, একালে উপন্যাসের আকার আয়তন ও আঙ্গিকের অদ্ভুত পরিবর্তন হয়েছে। সেদিক থেকে বিভূতিভূষণের উপন্যাস অভিনব ও মৌলিক।

No comments