বিংশ শতাব্দীর তিনি একজন সুপ্রতিষ্ঠিত কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় । রবীন্দ্রোত্তর পর্বের একজন যথার্থ শিল্পি । আজ তিনি জীবিত নন, ক...
বিংশ শতাব্দীর তিনি একজন সুপ্রতিষ্ঠিত কথা সাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় । রবীন্দ্রোত্তর পর্বের একজন যথার্থ শিল্পি । আজ তিনি জীবিত নন, কিন্তু তিনি তাঁর সৃষ্টি কর্মের মধ্যে দিয়ে আমাদের মনের মধ্যে জীবিত রয়েছেন এবং তিনি চিরকাল বেঁচে থাকবেন আমাদের মনে।
পরিচয় :
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৯৮ সালের ২৩ জুুুুলাই পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার লাভপুর গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তারাশঙ্করের পিতা ও মাতা হলেন হরিদাস বন্দ্যোপাধ্যায় ও প্রভাবতী দেবী। তারাশঙ্করের পিতা ও মাতা ছিলেন কালি ও তারা মায়ের ভক্ত তাই তাদের বাড়িতে নিয়মিত কালি ও তারা মায়ের পূজা হত। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্মের পূর্বে তারাশঙ্করের পিতা ও মাতার জৈষ্ঠ্য পুত্রের মৃত্যু হয়। পরে তাদের পরিবারে তারা মায়ের পূজো হবার দশ মাস পরে তারাশঙ্করের জন্ম হয়। তারাশঙ্করের পিতা ও মাতা মনে করেন তাঁদের পুত্র তারা মায়ের দয়া, তাই তাদের পুত্রের নামকরন করেন তারাশঙ্কর। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লাভপুরের যাদবলাল হাই স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়ে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন । এই সময় গান্ধীজীর দ্বারা অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয় ফলে তিনি এই অসহযোগ আন্দোলনে যোগদান করেন এবং এখানেই তাঁর শিক্ষা জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটে। এই স্বদেশী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগদান করেছিলেন ফলে তিনি গ্রেফতার হন এবং পরে তিনি মুক্তি পেয়ে সাহিত্য জীবনে তিনি নিজেকে সমর্পণ করেন। ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৪ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান ।
তারাশঙ্করের সাহিত্যকর্মঃ
সাহিত্য কর্মজীবনে তারাশঙ্কর ৬৫ টি উপন্যাস, ৫৩টি গল্পগ্রন্থ, ১২ টি নাটক, ৪টি প্রবন্ধ গ্রন্থ, ১টি কাব্যগ্রন্থ ও ১টি প্রহসন রচনা করেছেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় একসময় 'কল্লোল' গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিলেন এবং তিনি কিছু কবিতা রচনা করেছিলেন। পরে তিনি কথা সাহিত্যের পথে মনোনিবেশ করে কথা সাহিত্যের দ্বারা তিনি মানব জীবনের বিশাল রূপকে তিনি সকল মানুষের দৃষ্টিগোচর করেছেন। তারাশঙ্করকে টমাস হার্ডির সাথে তুলনা করা হয় ।
রচনাবলী :
প্রথম রচনা :
(a) ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে লাল কালিতে ছাপা ষাট পৃষ্ঠার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘ত্রিপত্র’ প্রকাশিত হয় ।
(b) প্রথম উপন্যাস ‘দীনের দান’ । এটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি । শিশির বসু সম্পাদিত ‘এক পয়সার সিরিজ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল ।
(c) ১৯৩২ সালে প্রথম উপন্যাস "চৈতালী ঘূর্ণি" গ্রন্থাকারে প্রকাশ পায়।
(d) তারাশঙ্করের লেকা প্রথম গল্প - ‘রসকলি’ ।
(e) প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘ছলনাময়ী’ (১৯৩৬) ।
(f) প্রথম স্মরণীয় গল্পগ্রন্থ ‘জলসাঘর’ ।
(g) প্রথম নাটক -- ‘মারাঠা তর্পণ’ (কলকাতার রঙ্গমঞ্চে নাটকটি অভিনীত না হওয়ায় তিনি ক্ষোভে, দুঃখে এই নাটকের পান্ডুলিপি পুড়িয়ে দেন)।
(h) প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস -- ‘গন্নাবেগম’ (১৯৬৫) ।
উপন্যাসঃ
তারাশঙ্করের উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলি হল :
- ‘চৈতালি ঘূর্ণি’ (১৯৩২)
- ‘পাষাণপুরী’ (১৯৩৩)
- ‘নীলকণ্ঠ’ (১৯৩৩)
- ‘রাইকমল’ (১৯৩৫)
- ‘প্রেম ও প্রয়োজন’ (১৯৩৬)
- ‘আগুন’ (১৯৩৮)
- ‘ধাত্রীদেবতা’ (১৯৩৯)
- ‘কালিন্দী’ (১৯৪০)
- ‘কবি’ (১৯৪২)
- ‘গণদেবতা’ (১৯৪৩)
- ‘মন্বন্তর’ (১৯৪৪)
- ‘পঞ্চগ্রাম’ (১৯৪৪)
- ‘কবি’ (১৯৪৪)
- ‘সন্দীপন পাঠশালা’ (১৯৪৬)
- ‘ঝড় ও ঝরাপাতা’ (১৯৪৬)
- ‘অভিযান’ (১৯৪৬)
- ‘সন্দীপন পাঠশালা’ (১৯৪৮)
- ‘পদচিহ্ন’ (১৯৫০)
- ‘উত্তরায়ণ’ (১৯৫০)
- ‘হাঁসুলীবাঁকের উপকথা’ (১৯৫১)
- ‘তামস তপস্যা’ (১৯৫২)
- ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’ (১৯৫২)
- ‘আরোগ্য নিকেতন’ (১৯৫৩)
- ‘চাঁপাডাঙার বৌ’ (১৯৫৪)
- ‘পঞ্চপুত্তলি’ (১৯৫৬)
- ‘বিচারক’ (১৯৫৭)
- ‘সপ্তপদী’ (১৯৫৮)
- ‘বিপাশা’ (১৯৫৯)
- ‘রাধা’ (১৯৫৯)
- ‘মানুষের মন’ (১৯৫৯)
- ‘ডাকহরকরা’ (১৯৫৯)
- ‘মহাশ্বেতা’ (১৯৬১)
- ‘যোগভ্রষ্ট’ (১৯৬১)
- ‘না’ (১৯৬১)
- ‘নাগরিক’ (১৯৬১)
- ‘নিশিপদ্ম’ (১৯৬২)
- ‘যতিভঙ্গ’ (১৯৬২)
- ‘কান্না’ (১৯৬২)
- ‘কালবৈশাখী’ (১৯৬৩)
- ‘একটি চড়াই পাখি ও কালো মেয় ‘ (১৯৬৩)
- ‘জঙ্গলগড়’ (১৯৬৪)
- ‘মঞ্জরী অপেরা’ (১৯৬৪)
- ‘সংকেত’ (১৯৬৪)
- ‘ভুবনপুরের হাট’ (১৯৬৪)
- ‘বসন্তরাগ’ (১৯৬৪)
- ‘স্বর্গমর্ত্য’ (১৯৬৫)
- ‘বিচিত্রা’ (১৯৬৫)
- ‘গন্না বেগম’ (১৯৬৫)
- ‘অরণ্যবহ্নি’ (১৯৬৬)
- ‘হীরাপান্না’ (১৯৬৬)
- ‘মহানগরী’ (১৯৬৬)
- ‘গুরুদক্ষিণা’ (১৯৬৬)
- ‘শুকসারী কথা’ (১৯৬৭)
- ‘শক্করবাঈ’ (১৯৬৭)
- ‘মণিবৌদি’ (১৯৬৯)
- ‘ছায়াপথ’ (১৯৬৯)
- ‘কালরাত্রি’ (১৯৭০)
- ‘রূপসী বিহঙ্গিনী’ (১৯৭০)
- ‘অভিনেত্রী’ (১৯৭০)
- ‘ফরিয়াদ’ (১৯৭১)
- ‘শতাব্দীর মৃত্যু’ (১৯৭১)
- ‘কিষ্কিন্ধ্যা কাণ্ড’ (১৯৭২)
- ‘নবদিগন্ত’(১৯৭৩)
- ‘কীর্তিহাটের কর্তা’ (১৯৭৬
ত্রয়ী উপন্যাস :
- ‘ধাত্রীদেবতা’ (১৯৩৯)
- ‘গণদেবতা’ (১৯৪৩)
- ‘পঞ্চগ্রাম’ (১৯৪৪)
উপন্যাস ও পূর্বনাম :
- ‘নীলকন্ঠ’ -- ‘যোগ বিয়োগ’ ।
- ‘রাইকমল’ -- ‘প্রেম ও প্রয়োজন’ ।
- ‘ধাত্রীদেবতা’ -- ‘জমিদারের মেয়ে’ ।
- ‘গণদেবতা’ --- ‘চন্ডিমন্ডপ’ ।
- ‘আরোগ্য নিকেতন’ --- ‘সঞ্জীবন ফার্মেসী’ ।
উৎসর্গীকৃত উপন্যাস :
- ‘চৈতালী ঘুর্ণি’ -- সুভাষচন্দ্র বসু ।
- ‘নীলকন্ঠ’ -- শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় ।
- ‘হাসুলীবাঁকের উপকথা’ -- কবিশেখর কালিদাস রায় ।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কিছু উল্লেখযোগ্য ছোটগল্পের নাম হল :
- ‘ছলনাময়ী’ (১৯৩৭)
- ‘জলসাঘর’ (১৯৩৮)
- ‘রসকলি’ (১৯৩৯)
- ‘তিন শূন্য’ (১৯৪২)
- ‘প্রতিধ্বনি’ (১৯৪৩)
- ‘বেদেনী’ (১৯৪৩)
- ‘দিল্লী কা লাড্ডু ’(১৯৪৩)
- ‘যাদুকরী’ (১৯৪৪)
- ‘স্থলপদ্ম’ (১৯৪৪)
- ‘তেরশো পঞ্চাশ’ (১৯৪৪)
- ‘প্রসাদমালা’ (১৯৪৫)
- ‘হারানো সুর’ (১৯৪৫)
- ‘ইমারত’ (১৯৪৭)
- ‘রামধনু’ (১৯৪৭)
- ‘কামধেনু’ (১৯৪৯)
- ‘মাটি’ (১৯৫০)
- ‘শিলাস্থান’ (১৯৫২)
- ‘বিস্ফোরণ’ (১৯৫৫)
- ‘কালান্তর’ (১৯৫৬)
- ‘বিষপাথর’ (১৯৫৭)
- ‘রবিবারের আসর’ (১৯৫৯)
- ‘পৌষলক্ষ্মী’ (১৯৬১)
- ‘চিরন্তনী’ (১৯৬২)
- ‘অ্যাক্সিডেন্ট’ (১৯৬২)
- ‘তমসা’ (১৯৬৩)
- ‘আয়না’ (১৯৬৩)
- ‘চিন্ময়ী’ (১৯৬৪)
- ‘একটি প্রেমের গল্প’ (১৯৬৫)
- ‘দীপার প্রেম’ (১৯৬৬)
- ‘নারী রহস্যময়ী’ (১৯৬৭)
- ‘পঞ্চকন্যা’ (১৯৬৭)
- ‘শিবানীর অদৃষ্ট’ (১৯৬৭)
- ‘গোবিন সিংয়ের ঘোড়া’ (১৯৬৮)
- ‘জয়া’ (১৯৬৮)
- ‘এক পশলা বৃষ্টি’ (১৯৬৯)
- ‘মিছিল’ (১৯৬৯)
- ‘উনিশশো একাত্তর’ (১৯৭১)
নাটক :
- ‘কালিন্দী’ (১৯৪২),
- ‘দুইপুরুষ’(১৯৪৩),
- ‘পথের ডাক ’(১৯৪৩),
- ‘বিংশ শতাব্দী’(১৯৪৫),
- ‘দ্বীপান্তর’ (১৯৪৫),
- ‘যুগবিপ্লব’ (১৯৫১),
- ‘কবি’ (১৯৫৭),
- ‘কালরাত্রি’ (১৯৫৭),
- ‘ সংঘাত’ (১৯৬২),
- ‘আরোগ্য নিকেতন’ (১৯৬৮)
- ‘সাহিত্যের সত্য’ (১৯৬১),
- ‘ ভারতবর্ষ ও চীন’ (১৯৬৩),
- ‘রবীন্দ্রনাথ ও বাংলার পল্লী’ (১৯৭১)।
স্মৃতিকথা:
- ‘আমার কালের কথা’ (১৯৫১),
- ‘বিচিত্র স্মৃতিকাহিনী’ (১৯৫৩),
- ‘আমার সাহিত্য জীবন’(প্রথম খণ্ড -১৯৫৩, দ্বিতীয় খণ্ড -১৯৬২)
- ‘কৈশোর স্মৃতি’ (১৯৫৬), ।
রচনা-সংকলন :
- ‘তারাশঙ্করের শ্রেষ্ঠ গল্প ’(১৯৪৭),
- ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ গল্প’ (১৯৫০),
- ‘তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রিয় গল্প’ (১৯৫৩),
- ‘স্বনির্বাচিত গল্প’ (১৯৫৪),
- ‘গল্প-সঞ্চয়ন’ (১৯৫৫),
- ‘ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প’ (১৯৫৬),
- ‘রচনাসমগ্র’ (১৯৫৯),
- ‘প্রেমের গল্প’ (১৯৬১),
- ‘ছোটদের ভালো ভালো গল্প’ (১৯৬২),
- ‘গল্প-পঞ্চাশৎ’ (১৯৬৩),
- ‘কিশোর সঞ্চয়ন’ (১৯৬৬),
- ‘ছোটদের শ্রেষ্ঠ গল্প’ (১৯৬৯) ।
প্রহসন : ‘চকমকি’ (১৯৪৫) ।
ভ্রমণসাহিত্য : ‘মস্কোতে কয়েক দিন’ (১৯৫৯) ্।
কাব্যগ্রন্থ : ‘ত্রিপত্র’ (১৯২৬)
পুরস্কার ও উপাধিঃ
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় সাহিত্যকর্ম জীবনে নানা পুরস্কার ও উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।
(A) কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি 'শরৎস্মৃতি' পুরস্কার পান ও 'জগত্তারিণী স্মৃতি' পদক লাভ করেন।
(B) তিনি 'আরোগ্য নিকেতন' রচনার জন্য 'রবীন্দ্র পুরস্কার' ও 'সাহিত্য আকাদেমি' পুরস্কার পান।
(C) 'গনদেবতা' উপন্যাসের জন্য জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পান।
(D) তিনি পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ উপাধিতে ভূষিত হন।
বাংলা উপন্যাস জগতের শ্রেষ্ঠ :
ক) তিনিই একমাত্র উপন্যাসিক যিনি কালান্তরের কথাকার।
খ) বিশ শতকের প্রথম পট থেকেই যে তিন বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা কথাসাহিত্যে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন তিনি তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। যার সাহিত্যের অন্যতম বিষয় ছিল রাঢ় বাংলা।
গ) তাঁর রচনায় বিষয়বস্তু বিস্তৃত বিভিন্ন ক্ষেত্রে। শ্রেণীবিভক্ত সমাজ এবং তথাকথিত অন্ত্যজ ও সমাজ মারাত্মকভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে।
ঘ) আস্তিক্যবাদ তারাশঙ্করের অনিষ্ট। সেকারণে সমস্ত রকম বন্ধন থেকে মুক্তিলাভের উপন্যাসের মূল উপজীব্য।
ঙ) প্রকৃতি-মাটি- আলো-আকাশ তাঁর উপন্যাসের কেন্দ্রীয় বিষয়।
চ) লোকসংস্কার ও ঐতিহ্য তাঁর উপন্যাসে অন্যতম উপাদান।
ছ) বাংলা আঞ্চলিক উপন্যাসের অন্যতম স্রষ্টা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
তারাশঙ্করকে উত্তর-শরণযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ কথাকার :
তারাশঙ্করের উপন্যাস ও ছোটো গল্পে যে দুর্লভ বলিষ্ঠতা ও তীব্র অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় রয়েছে, যে বিশাল মানববোধের চিত্র উদঘাটিত হয়েছে, সমসাময়িক দেশকালের ঐতিহাসিক জীবনচিত্র যেভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে, তাতে শরত্চন্দ্রের যোগ্য উত্তরাধিকারিত্ব তারাশঙ্করের মধ্যে রয়ে গেছে। উত্তর শরৎ যুগের তিনি যে সর্বশ্রেষ্ঠ কথাকার তাতে দ্বিধা নেই।
‘তারাশঙ্কর বাস্তববাদী কথাশিল্পী – আলোচনা :
বাস্তববাদী শিল্পী তারাশঙ্কর জীবনের প্রত্যক্ষরূপের মধ্যে ডুব দিয়েই তৃপ্তি পেয়েছেন। দেহ-মন প্রাণধারী মনুষ্যের ট্র্যাজেডিতেই তিনি কাতর। কোনো অনির্দেশ্য বেদনায় তিনি ভারাক্রান্ত নন। ‘ধাত্রীদেবতা' থেকে আরম্ভ করে “নাগিনীকন্যার কাহিনি” পর্যন্ত বিস্তৃত কালখণ্ডে তারাশঙ্কর সৃষ্টি ক্ষমতার চরমে পৌঁছেছিলেন। কোনো কোনো উপন্যাসে একটা বৃহৎ মানবগোষ্ঠীর সামগ্রিক চিত্র প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। কাহার-বাউরিদের সমাজ, সাপুড়ের পল্লি, ঝুমুরের দল তাদের সব বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে। শুধু গোষ্ঠীগত নয়, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য্য চরিত্র সৃষ্টিতেও তারাশঙ্কর আশ্চর্য নিপুণতা দেখিয়েছেন।
কথাশিল্পী তারাশঙ্করের বিশিষ্টতার পরিচয় :
কথাশিল্পী তারাশঙ্করের উপন্যাস ও ছোটো গল্পে জীবনের প্রবৃত্তিতাড়িত রূপ প্রকাশিত। গ্রাম্য শ্রমজীবী মানুষের কথায়, একটা সম্প্রদায়ের বা একটা অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ চিত্রাঙ্কনে তারাশঙ্করের উপন্যাস মহাকাব্যিক বিশালতা লাভ করেছে।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়কে কি ছোটো গল্পের ক্ষেত্রে আঞ্চলিক লেখক বলা যায় ?
হ্যা। তারাশঙ্করের অনেকগুলি ছোটো গল্পে প্রবৃত্তিতাড়িত মানুষের যে অমার্জিত জান্তব রূপের পরিচয় মেলে তা যেন এই আঞ্চলিকতারই (রাঢ়) প্রতিনিধি। রাঢ়-ভূমির যে মাটি থেকে তারা উঠে এসেছে, সেখানকার রৌদ্রদগ্ধ পিপাসা, জলহীন পাণ্ডুর মাটিতে দ্বাদশ সূর্যের দাহ সেখানকার চরিত্রগুলির স্বভাবেও যেন একপ্রকার লেলিহান রসনা, স্নেহপ্রেম, লোভলালসার একপ্রকার অগ্নিতপ্ততা সঞ্চার করেছে।
তারাশঙ্কর কি জৈবিক বৃত্তির ভাষ্যকার— আলোচনা :
তারাশঙ্কর কোনো জৈবিক বৃত্তির ভাষ্যকার নন, আদিম প্রবৃত্তির লীলাপ্রদর্শক মাত্র নন, তিনি মানবশিল্পী। কোমলেকঠোরে বিচিত্র রূপ তিনি পরিবেশন করেছেন। আদিমতার মরুভূমির মধ্যে কোমলতার মরূদ্যানও তাঁর চোখে পড়েছে। এই প্রসঙ্গে ‘মতিলাল’ ও ‘ডাইনি’ গল্প দুটি উল্লেখযোগ্য । আবার প্রবৃত্তির ভয়ংকর দিকটা দেখানো হয়েছে ‘বেদেনী’ গল্পে।

No comments