Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

শাক্ত পদাবলীর কবি রামপ্রসাদ সেনঃ

মাতৃসাধক ও ভক্ত কবি রামপ্রসাদ সেন শাক্ত গীতিকারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ—তার পদে আধ্যাত্মিকতা ও জীবনরসের এক সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটে...


মাতৃসাধক ও ভক্ত কবি রামপ্রসাদ সেন শাক্ত গীতিকারদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এই শ্রেষ্ঠত্বের কারণ—তার পদে আধ্যাত্মিকতা ও জীবনরসের এক সুষ্ঠু সমন্বয় ঘটেছে এবং তার প্রকাশ হয়েছে সহজ, স্বচ্ছ ও সাবলীল। তিনি গভীর ভাবের বিষয়কে সহজভাবে ব্যক্ত করতে পেরেছেন বলেই তিনি উৎকৃষ্ট শাক্তপদকার। সেজন্যই সমালোচকের সঠিক মস্তব্য— 
     “বৈষ্ণব সঙ্গীত সাহিত্যে চণ্ডীদাসের যে আসন, শাক্ত সঙ্গীত সাহিত্যে রামপ্রসাদেরও ঠিক সেই আসন।”

ব্যক্তি জীবনঃ
        ঈশ্বরগুপ্ত সর্বপ্রথম রামপ্রসাদের জীবনী সংগ্রহের চেষ্টা করেন। তার মতে রামপ্রসাদ হালিসহরের অন্তর্গত কুমারহট্ট গ্রামে ১৭২০-২১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেহরক্ষা করেন।  রামপ্রসাদ জন্মগ্রহণ করেন।তার পিতা ছিলেন রামরাম সেন। পিতার দুই বিবাহ এবং দ্বিতীয় পক্ষের তৃতীয় সন্তান ছিলেন রামপ্রসাদ। রামপ্রসাদের দুই পুত্র ও দুই কন্যা। পিতার মৃত্যুর পর তিনি অল্প বয়সেই বিষয়কর্মে লিপ্ত হন। কলকাতার কোন এক ধনাঢ্য ভূস্বামীর বাড়ীতে তিনি মুহুরিগিরির কাজ করতেন। অল্প বয়সে তিনি শাক্ত ধর্মে দীক্ষা নেন। তার সম্বন্ধে নানান অলৌকিক গল্প প্রচলিত রয়েছে। স্বয়ং দেবী কালিকা কবির কন্যা সেজে বেড়া বাঁধতে কবিকে সাহায্য করেছিলেন। দেবী অন্নপূর্ণা তাঁর গান শোনার জন্য কাশী ছেড়ে কবির চণ্ডীমণ্ডপে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি বিশিষ্ট গায়ক ছিলেন। 

রামপ্রসাদের কাব্যঃ
        ‘বিদ্যাসুন্দর’, ‘কৃষ্ণকীর্তণ’, ‘কালীকীর্তণ’, ‘সীতাবিলাপ’। রামপ্রসাদের গানে যে সাদামাঠা সুর রয়েছে তাকে 'প্রসাদী সুর নামে বলা হয়।


উপাধিঃ
       রামপ্রসাদ সেনের উপাধি ছিল‘কবিরঞ্জন’ । ‘বিদ্যাসুন্দর’ ও ‘কৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য রচনার জন্য নবদ্বীপের ( কৃষ্ণনগরের) মহারাজা এই উপাধি দিয়েছিলেন । 

রামপ্রসাদ সেনের পদাবলীঃ
আগমনীঃ
➤ ‘গিরি এবার আমার উমা এলে, আর উমা পাঠাবো না’
➤ ‘ওগো রানী নগেরে কোলাহল, উঠ, চল চল’

বিজয়াঃ
➤ ‘ওহে প্রাননাথ, গিরিবর হে, ভয়ে তনু কাঁপিছে আমার’

ভক্তের আকুতি পর্যায়ঃ
➤ ‘মা আমায় ঘুরাবে কত / কলুর চোখ বাঁধা বলদের মতো’ 
➤ জননী পদ পঙ্কজ দেহি’
➤ ‘বল মা আমি দাঁড়াই কোথা  ‘
➤ ‘বাজবে গো মহেশের হ্রদে’
➤ ‘ভবের আশা খেলবো পাশা’
➤  ‘মলেম ভূতের বেগার খেটে’
➤ ‘মা গো তারা ও শঙ্করী’

জগজ্জনীর রূপঃ
➤ ‘ঢলিয়ে ঢলিয়ে কে আসে, গলিতে চিবুক আসব আবেশে’

মনোদীক্ষা পর্যায়ের পদঃ
➤ ‘মন তোর এই ভ্রম গেলো না’
➤  ‘মন তোর এত ভাবনা কেন  ‘
➤ ‘মনরে কৃষিকাজ জানো না’
➤ ‘আয় মন বেড়াতে যাবি’
➤ ‘ডুব দে’রে মন কালি বলে’ ।

সঙ্গীতের বিভাজনঃ
        রামপ্রসাদের সঙ্গীতগুলিকে বিষয় অনুযায়ী ভাগ করা যেতে পারে
ক) উমা বিষয়ক (আগমনী ও বিজয়া)।
খ) সাধন বিষয়ক (তন্ত্র নির্ভর সাধনা)।
গ) জগজ্জননীর রূপ বা স্বরূপ বিষয়ক।
ঘ) তত্ত্বদর্শন ও নীতি বিষয়ক ।

রামপ্রসাদী  সংগীতের জয়প্রিয়তার কারণঃ
(a) ভাষার সরলতা, ভাবের গভীরতা, সহজ প্রকাশভঙ্গি ও লিরিক সুরমূৰ্চ্ছনায় প্রসাদি সংগীতগুলির আবেদন সর্বব্যাপক।
(b) সহজ কবিশক্তির গভীরতম প্রদেশ থেকে গানগুলি উৎসারিত। 
(c) সহজ ভাষায়, সরল সুরে ও চলিত ভাষায় ছন্দে এবং প্রাণঢালা আবেগে গানগুলি বাংলা সাহিত্যের অমূল্যসম্পদ।
(d)  রামপ্রসাদ তাঁর সংগীতগুলিতে মানুষের শাস্তি, স্বস্তি ও নির্ভরতার এক আশ্চর্য জগৎ গড়ে তুলেছেন।

রামপ্রসাদী সংগীতে ভক্তিভাবের পরিচয়ঃ
           রামপ্রসাদি সংগীতে যে সহজ ভক্তিভাব ফুটে উঠেছে তা সবজনবোধ্য সরল চলিত ভাষায় । বৈষ্ণব পদাবলির চণ্ডীদাসের মতো তিনি সহজ সুরে গভীর কথা শুনিয়েছেন। তাঁর গানে জীবনরস, আধ্যাত্মিকতা, দার্শনিকতা ও গূঢ়তত্ত্ব কথা একসঙ্গে মিশে রয়েছে।


রামপ্রসাদী সংগীতে ধর্মীয় উদারতাঃ
          ধর্মীয় উদারতা রামপ্রসাদের গানের লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য। রামপ্রসাদের ‘ব্রহ্মময়ী সর্বঘটে। তিনি সাম্প্রদায়িক ধর্মবিদ্বেষের মূলে কুঠারাঘাত করে শাস্ত্রীয় পূজা ও পূজার উপকরণের তুচ্ছতার দিকটি সহজ ভাষায় সকলের কাছে তুলে ধরেছেন। বাহ্যাড়ম্বর সর্বস্ব পূজাপদ্ধতির অস্তঃসারশূন্যতা ও ভক্তিভাবের গভীরতা তাঁর গানে অনবদ্য ভাষায় প্রদীপ্ত হয়েছে।

রামপ্রসাদের পদাবলীর বিশেষত্বঃ
          শুধু ভাব, ছন্দ ও অলংকার নয়, বিশিষ্ট গীতরীতির (রামপ্রসাদি সুর) জন্য রামপ্রসাদের পদাবলি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশেষত্বের স্বকীয় মর্যাদায় সুপ্রতিষ্ঠিত। যে চলিতভাষা ও ছন্দরে রামপ্রসাদ ভাবপ্রকাশের অন্যতম বাহন হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, বাংলা সাহিত্যের বিবর্তনের ইতিহাসে তা নতুন দিক পরিবর্তনের গুরুতর তাৎপর্যে মূল্যায়িত।

কান্ত কবি বলার কারণঃ
         রামপ্রসাদকে সর্বকালের লোককান্ত কবি বলা হয় ।  জনজীবনের সুখদুঃখে রামপ্রসাদের পদাবলি রসসিক্ত বলেই তিনি সর্বকালের লোককান্ত কবি।

রামপ্রসাদ সমস্যা ঃ
রামপ্রসাদকে কেন্দ্র করে পন্ডিতমহলে নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। মুখ্যত তিনজন রামপ্রসাদের নাম আমরা পাই –
ক) কবিরঞ্জন রামপ্রসাদ।
খ) পূর্ববঙ্গের চিনিশপুরের কালীসাধক দ্বিজ রামপ্রসাদ বা রামপ্রসাদ ব্রহ্মচারী।
গ) রামপ্রসাদ চক্রবর্তীনামে কবিওয়ালা কালীকীর্তণ লিখেছেন। কলকাতার সিমলা অঞ্চলের লোক ছিলেন তিনি।

বৈষ্ণব পদাবলী ও শাক্তপদাবলীর মৌলিক পার্থক্যঃ
            বৈষ্ণব পদাবলী ও শাক্তপদাবলীর দুটি মৌলিক পার্থক্য –
(ক) বৈষ্ণবপদাবলী মূলতঃ সৌন্দর্যের কাব্য কিন্তু শাক্ত পদাবলী জীবনের কাব্য। 
(খ) বৈষ্ণব পদাবলীতে শ্রীরাধার প্রেয়সী মূর্তি, শাক্ত পদাবলীতে উমা ও শ্যামার জননী মূর্তি ও কন্যা মূর্তি।


এক নজরে রামপ্রসাদ সেন


1. শাক্ত পদাবলীর শ্রেষ্ঠ পদকর্তা রামপ্রসাদ সেন ।  
2. শাক্ত পদাবলীর ‘আদি গঙ্গা হরিদ্বার’ বলা হয় রামপ্রসাদ সেনকে । 
3. কবি ঈশ্বর গুপ্ত রামপ্রসাদ সেন সম্পর্কে প্রথম তথ্য সংগ্রহ করেন । 
4. ঈশ্বর গুপ্তের তথ্য অনুযায়ী রামপ্রসাদ সেন ২৪ পরগনার হালি শহরের কুমারহট্ট গ্রামে ১৭২০ - ২১ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহন করেন । ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান । 
5. রামপ্রসাদ সেনের পিতার নাম রামরাম সেন । 
6. রামপ্রসাদ পিতার দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান ।
7. রামপ্রসাদের দুই পুত্র -- রামদুলাল ও রামমোহন । দুই কন্যা --- পরমেশ্বরী ও জগদীশ্বরী । 
8. রামপ্রসাদ সেনের উপাধি ছিল‘কবিরঞ্জন’ । ‘বিদ্যাসুন্দর’ ও ‘কৃষ্ণকীর্তন’ কাব্য রচনার জন্য নবদ্বীপের ( কৃষ্ণনগরের) মহারাজা এই উপাধি দিয়েছিলেন । 
9. রামপ্রসাদ ভক্তের আকুতি পর্যায়ের পদ রচনায় শ্রেষ্ঠত্ব দেখিয়েছেন । 
10. রামপ্রসাদ সেন শাক্ত পদাবলী ছাড়া ‘বিদ্যাসুন্দর’ ও ‘কৃষ্ণকীর্তন’  কাব্য লিখেছিলেন ।
11. রামপ্রসাদের শাক্ত পদাবলী ‘প্রসাদী সংগীত’ নামে পরিচিত । 
12. প্রথমে রামপ্রসাদের মুদ্রিত পদাবলীর সংখ্যা ছিল একশো (১০০) । 
রামপ্রসাদ প্রায় ৩০০টি পদ রচনা করেছেন । 
13. রামপ্রসাদের গান শুনে নবাব সিরাজদ্দৗলা অবিভূত হয়েছিলেন । 

No comments