সপ্তদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রাম-আরাকানে দুজন শক্তিমান মুসলমান কবির আবির্ভাব ঘটেছিল—বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যাদের অবদান যথেষ্ট। এঁরা হলেন দৌলত কাজ...
সপ্তদশ শতাব্দীতে চট্টগ্রাম-আরাকানে দুজন শক্তিমান মুসলমান কবির আবির্ভাব ঘটেছিল—বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যাদের অবদান যথেষ্ট। এঁরা হলেন দৌলত কাজী এবং সৈয়দ আলাওল। এই কবিরা ধর্মনিরপেক্ষ দেবভাবনামুক্ত অবিমিশ্র মানবিক চেতনার জয়গান গেয়েছেন—যা মধ্যযুগের গতানুগতিক ধারা থেকে স্বতন্ত্র। ব্রহ্মদেশের নিম্নভাগের সংলগ্ন অঞ্চল ছিল আরাকান। এখানকার অধিবাসীরা ছিলেন মগ। রাজাও ছিলেন মগ জাতীয় বৌদ্ধ। এই রাজাদের উৎসাহে ও পৃষ্ঠপোষকতায় কবিরা কাব্য রচনা করেছিলেন।
কবি পরিচয়ঃ
সপ্তদশ শতাব্দীর রোসাঙ রাজসভার একজন মুসলমান কবি সৈয়দ আলাওল । সৈয়দ আলাওল রচিত ‘সেকেন্দারনামা’ ও ‘সয়ফুলমুলক’ গ্রন্থে কবির আত্মপরিচয় পাওয়া যায় । এই দুই গ্রন্থ অনুসারে জানা যায় আলাওল চট্টগ্রামে ( মতান্তরে ফরিদপুরে ) ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মগ্রহন করেন । ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা মজলিস কুতুবের অমাত্য পুত্র সৈয়দ আলাওল । আলাওলের পিতা ফতেহাবাদের মজলিস কুতুবের মন্ত্রী ছিলেন । আলাওলের সময় আরকানের রাজা ছিলেন রাজা সুধর্মা । কবি ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান ।
কাব্য পরিচয়ঃ
সৈয়দ আলাওলের কাব্যের সংখ্যা ৬টি (মতান্তরে ৭টি) । কাব্যগুলি যথাক্রমে ---
(i) ‘পদ্মাবতী’ -- ১৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দ ।
(ii) ‘লোরচন্দ্রানী’র শেষাংশ -- ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দ ।
(iii) ‘সয়ফুলমূলক বদউজ্জমাল’ -- ১৬৫৮ -৭০ খ্রিষ্টাব্দ ।
(iv) ‘সপ্তপয়কর’ / ‘হপ্তপয়কর’ -- ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দ ।
(v) ‘তোহফা’ -- ১৬৬৩ - ৬৯ খ্রিষ্টাব্দ ।
(vi) ‘সেকেন্দারনামা’ -- ১৬৭২ খ্রিষ্টাব্দ ।
(vii) ‘রাগতালনামা’ (এই রচনাটি সৈয়দ আলাওলের কিনা সন্দেহ রয়েছে) ।
কাব্য আলোচনাঃ
(i) ‘পদ্মাবতী’:
➤ আনুমানিক ১৬৪৬ খ্রিষ্টাব্দে রচিত হয় ।
➤ মহম্মদ জায়সীর ‘পদুমাবৎ’ কাব্য অবলম্বনে এই কাব্য রচিত ।
➤ এই কাব্যের প্রধান পৃষ্ঠপোষক মাগন ঠাকুর ।
➤ ‘পদ্মাবতী’ ইতিহাসাশ্রিত রোমান্টিক প্রেমকাব্য ।
➤ ‘পদ্মাবতী’ ৫৬টি খন্ডে বিন্যস্ত ।
➤ সাধুভাষায় পয়ার ত্রিপদী ছন্দে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ কাব্য রচনা করেন ।
➤ ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের ইংরাজি অনুবাদ করেন গীয়ার্সন এবং শিরেফ ।
➤ সাধুভাষায় পয়ার ত্রিপদী ছন্দে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ কাব্য রচনা করেন ।
➤ এই কাব্যের চরিত্র - রত্নসেন, নাগমতী, পদ্মাবতী , আলাউদ্দিন খিলজী ।
➤ ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের বিষয়বস্তুঃ
সিংহল রাজকন্যা ও মেবারের রানি পদ্মাবতী বা পদ্মিনীকে নিয়ে এই কাব্যটি রচিত। আলাউদ্দিন খিলজি রত্নসেনের রানি পদ্মিনীর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে শক্তিবলে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্য চিতোর আক্রমণ করেন। এই দস্যুর কবল থেকে সতীত্বধর্ম রক্ষার্থে পদ্মিনী জহরব্রতে আত্মত্যাগ করেন। মূল কাব্যে (জায়সির পদুমাবৎ) ইতিহাসের চেয়ে কল্পনার প্রাধান্য বেশি, তা ছাড়া জায়সি সুফিসাধক ছিলেন বলেই উক্ত ঐতিহাসিক কাহিনিকে জীবাত্মা-পরমাত্মার রূপ হিসেবেই গ্রহণ করেছেন।
‘➤ ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের উৎকর্ষতাঃ
‘পদ্মাবতী’ কাব্যই আলাওলের কবি প্রতিভার প্রধান পরিচায়ক। এ কাব্যকে মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের প্রথম সারির রচনার অন্তর্ভুক্ত করা চলে। এ কাব্যে আছে জীবনের উদ্দাম উচ্ছ্বাস, অট্টহাস্য মুখরতা, বিচিত্র দুঃসাহসিক অভিযানের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। সমকালীন রোসাঙ্গ বাজের সামরিক অবস্থার কাহিনীও স্থান পেয়েছে।
(ii) ‘লোরচন্দ্রানী’র শেষাংশ :
➤ আনুমানিক ১৬৫৯ খ্রিষ্টাব্দে রচিত ।
➤ এর উৎস ‘সতী ময়না’ আখ্যান ।
➤ আরকান রাজের মহামাত্য সুলেমানের নির্দেশে রচিত ।
➤ দৌলত কাজীর অসাপ্ত কাব্য ।
(iii) ‘সয়ফুলমূলক বদিউজ্জমাল’:
➤ আনুমানিক ১৬৫৮ - ৭০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত ।
➤ এর উৎস ‘ইসলামী রোমান্টিক কাহিনী’ ।
➤ মাগন ঠাকুরের অনুরোধে রচিত ।
➤ গ্রন্থটি আরবি থেকে অনুবাদ করা ।
➤ গ্রন্থের মূল বিষয় ছিল মিশরের বাদশাহ ছিপিয়ানের পুত্র সয়ফুলমুলুকের সঙ্গে বােস্তানের রাজকন্যা বদিউজ্জমালের রােমান্টিক প্রণয় কাহিনী।
➤ এই কাব্যের নায়ক - সয়ফুল এবং নায়িকা বদিউজ্জমাল ।
➤ কাব্যের বিষয়বস্তুঃ
নায়ক সয়ফুলমূলক ও নায়িকা বিদয়উজ্জমালের প্রেমকাহিনি এর বিষয়বস্তু। এই কাব্যটি মুসলিম সমাজে খুবই জনপ্রিয়। মানব নায়কের সঙ্গে পরী প্রেমিকার মিলন কাহিনি লিখে আলাওল মানবলোক ও স্বপ্নলোকের মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করেছিলেন। এই কাবোর লক্ষণীয় বৈশিষ্ট স্বপ্নমেদর লোকাতীত পরিবেশ সৃষ্টি।
(iv) ‘সপ্তপয়কর’ / ‘হপ্তপয়কর’:
➤ আনুমানিক ১৬৬০ খ্রিষ্টাব্দে রচিত ।
➤ এর উৎস ‘নেজামি সমরকন্দের ‘সপ্তপয়কর’ ।
➤ সৈয়দ মহম্মদের অনুরোধে রচিত ।
➤ গ্রন্থটি আরবি থেকে অনুবাদ করা ।
➤ কাব্যের মূল বিষয় হল আরবের রাজকুমার বাহরামের যুদ্ধ জয় ও তাঁকে তাঁর সাত রানির বলা গল্প ।
(v) ‘তোহফা’:
➤ আনুমানিক ১৬৬৩ - ৬৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত ।
➤ এর উৎস সেখ রুসুফের ‘তুহফাতুন্নসা’ নামক ফরাসি নীতিকাব্য ।
➤আরকান রাজের মহামাত্য সুলেমানের নির্দেশে রচিত ।
➤ কাব্যের বিষয় হল মুসলমান সমাজের নীতিকথা ।
➤ গ্রন্থটি ফার্সি থেকে অনুবাদ করা ।
(vi) ‘সেকেন্দারনামা’:
➤ আনুমানিক ১৬৬৩ - ৭২ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে রচিত (তবে মনে করা হয় ১৬৬৩ খ্রিঃ রচিত) ।
➤ এর উৎস নেজামি সমরকন্দের ‘ইসকান্দারনামা’ ফরাসি কাব্য ।
➤ রাজা চন্দ্র সুধর্মার প্রধান অমাত্য নবরাজ মজলিশের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত ।
➤ আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমনের কাহিনী নিয়ে আলাওল ‘সেকেন্দারনামা’ রচনা করেন ।
➤ গ্রন্থটি ফার্সি থেকে অনুবাদ করা ।
➤ মনে করা হয় এটিই তার শেষ কাব্য ।
➤ কাব্য পরিচয়ঃ
নেজামি সমরখন্দের ফারসি কাব্য 'ইসকান্দার নামা'র সরস অনুবাদ। গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডারের সমরাভিযান ইসলামীয় কায়দায় এখানে বর্ণিত। এই গ্রন্থে ব্যাপক যুদ্ধবিগ্রহ ও রূপকথাধর্মী অনেক অদ্ভুত গল্প স্থান পেয়েছে। সেগুলি চিত্তাকর্ষক হলেও কাব্যগুণের দিক থেকে নগণ্য।
সৈয়দ আলাওলের কবি প্রতিভাঃ
আলাওল জীবনরসিক কবি। তিনি বহুভাষাবিদ ও শাস্ত্রজ্ঞ সুপণ্ডিত কবি ছিলেন বলেই বহুপাত্র থেকে জীবনের রস আহরণ করেছেন। তাঁর প্রতিভার ব্যাপকতা স্বীকার্য। হিন্দু ও মুসলমান জ্ঞানে তিনি সমান পারদর্শী ছিলেন। আলাওলের রচনা সরল অথচ প্রগাঢ়। 'পদ্মাবতী' তাঁর শ্রেষ্ঠ আখ্যায়িকা। আলাওলের কাব্যমালায় মাঝে মাঝে গান বা পদাবলি আছে। এগুলির কোনো কোনোটিতে তাঁর রচনাশক্তির বিশিষ্ট পরিচয় পাই।
|
এক নজরে
সৈয়দ আলাওল |
1. সপ্তদশ শতাব্দীর রোসাঙ রাজসভার একজন মুসলমান কবি সৈয়দ আলাওল ।
2. সৈয়দ আলাওল রচিত ‘সেকেন্দারনামা’ ও ‘সয়ফুলমুলক’ গ্রন্থে কবির আত্মপরিচয় পাওয়া যায় ।
3. এই দুই গ্রন্থ অনুসারে জানা যায় আলাওল চট্টগ্রামে ( মতান্তরে ফরিদপুরে ) ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে জন্মগ্রহন করেন ।
4. ফতেয়াবাদের শাসনকর্তা মজলিস কুতুবের অমাত্য পুত্র সৈয়দ আলাওল ।
5. আলাওলের পিতা ফতেহাবাদের মজলিস কুতুবের মন্ত্রী ছিলেন ।
6. আলাওলের সময় আরকানের রাজা ছিলেন রাজা সুধর্মা ।
7. কবি ১৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান ।
8. সৈয়দ আলাওলের কাব্যের সংখ্যা ৬টি (মতান্তরে ৭টি ) ।
9. ‘পদ্মাবতী’ ইতিহাসাশ্রিত রোমান্টি প্রেমকাব্য ।
10. ‘পদ্মাবতী’ ৫৬টি খন্ডে বিন্যস্ত ।
11. সাধুভাষায় পয়ার ত্রিপদী ছন্দে আলাওল ‘পদ্মাবতী’ কাব্য রচনা করেন ।
12. ‘পদ্মাবতী’ কাব্যের ইংরাজি অনুবাদ করেন গীয়ার্সন এবং শিরেফ ।
13. দৌলত কাজির অসমাপ্ত কাব্য ‘লোরচন্দ্রানী’ বা ‘সতীময়না’ শেষ করেন সৈয়দ আলাওল ।
14. আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমনের কাহিনী নিয়ে আলাওল ‘সেকেন্দারনামা’ রচনা করেন ।
15. সৈয়দ আলাওল আরবি থেকে অনুবাদ করেন ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জমাল’ ও ‘সপ্তপয়কর’ ।
16. সৈয়দ আলাওল ফার্সি থেকে অনুবাদ করেন ‘তোহফা’ ও ‘সেকেন্দারনামা’ ।
17. সৈয়দ আলাওলের ‘তোহফা’ ইসলামীয় নীতিকথা ।
18. আলাওলের লেখা দুটি প্রনয় কাব্য ‘পদ্মাবতী’ ও ‘সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জমাল’ ।
19. সৈয়দ আলাওলের লেখা সর্বশেষ গ্রন্থ ‘সেকেন্দারনামা’ ।
20. ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেব ঢাকা থেকে ‘পদ্মাবতী’র নতুন সংস্করণ সম্পাদনা করেছেন ।

No comments