Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ঃ

দ্বিজেন্দ্রলাল একাধারে কবি, নাট্যকার, সংগীত রচয়িতা, সুরকার, গায়ক এবং একজন স্বদেশপ্রেমিক। নাট্যকার হিসাবে তার খ্যাতি মূলত নাট্যসাহিত্যে আধ...


দ্বিজেন্দ্রলাল একাধারে কবি, নাট্যকার, সংগীত রচয়িতা, সুরকার, গায়ক এবং একজন স্বদেশপ্রেমিক। নাট্যকার হিসাবে তার খ্যাতি মূলত নাট্যসাহিত্যে আধুনিক নাটকের বৈশিষ্ট্য রূপায়ণে। রচনার আঙ্গিক, ভাষা ও ভাবের দিক থেকে তিনি বাংলা নাটকের মধ্যে সম্পূর্ণ নতুন দিকের আগমন ঘটালেন। নাট্যসাহিত্যে তাঁর অবদান মূলত ঐতিহাসিক নাট্যকার রূপে।

পরিচিতিঃ
          দ্বিজেন্দ্রলাল একই সাথে কবি ও নাট্যকার । নদীয়ার কৃষ্ণনগরে কবির জন্ম। পিতা কার্তিকেয়চন্দ্র রায়, মাতা প্রসনুময়ী দেবী । নাট্য সাহিত্যে পদার্পনের আগে কাব্য কবিতা নিয়ে ইংরাজিতে লেখার চেষ্টা করেন । ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার একমাত্র ইংরাজি কাব্যগ্রন্থ ‘Lyrics of Ind’ । নাট্যকার হিসাবে তাঁর প্রথম আবির্ভাব প্রহসনকার হিসাবে। তাঁর প্রথম প্রহসন ‘একঘরে' (১৮৮৯)। বিলাত থেকে ফেরার পর বিনা প্রায়শ্চিত্তে হিন্দু সমাজ তাকে গ্রহন করতে অসম্মত হয়, সমাজের এই অন্যায় ব্যবহারে ক্ষুব্ধ মনের প্রতিক্রিয়া এই রচনায় ব্যক্ত হয়েছে । তবে অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন তাঁর প্রথম প্রহসন ‘কল্কি অবতার (১৮৯৫)।

এক নজরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাট্যাবলীর সংক্ষিপ্ত পরিচয়ঃ
প্রহসনঃ
১. ‘একঘরে’ (১৮৮৯)
২. ‘কল্কি অবতার’ (১৮৯৫)
৩. ‘বিরহ’ (১৮৯৭)
৪. 'ত্র্যহস্পর্শ' (১৯০০)
৫. ‘প্রায়শ্চিত্ত' (১৯০২২)
৬. ‘পুনর্জন্ম’ (১৯০১)
৭. ‘আনন্দ বিদায়’ (১৯১২)


➤ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রথম প্রহসন ‘একঘরে' (১৮৮৯) । বিলাত থেকে ফেরার পর বিনা প্রায়শ্চিত্তে হিন্দু সমাজ তাকে গ্রহন করতে অসম্মত হয়, সমাজের এই অন্যায় ব্যবহারে ক্ষুব্ধ মনের প্রতিক্রিয়া এই রচনায় ব্যক্ত হয়েছে।
➤ প্রথম প্রহসনটিতে প্রহসন রস ঠিকমত না জমায় অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন তাঁর প্রথম প্রহসন ‘কল্কি অবতার’ (১৮৯৫)।
➤ ‘কল্কি অবতার নাটক' এ নাট্যকার ব্রাহ্ম উদীয়মান হিন্দু, বিলাত ফেরত শ্রেণী, গোঁড়া রক্ষনশীল ও পন্ডিত সমাজকে ব্যঙ্গ করেছেন।
➤ ‘প্রায়শ্চিত্ত’ নাটকটি বাল্যবন্ধু যোগেশচন্দ্র চৌধুরীকে উৎসর্গ করেন ।
➤ ‘আনন্দ বিদায়’ রবীন্দ্রনাথের 'কড়ি ও কোমল’ কাব্যকে আক্রমণ করে লেখা । ‘আনন্দ বিদায়’ সংক্ষিপ্তরূপে প্রথম প্রকাশিত হয় 'বঙ্গবাসী' পত্রিকায় (১৯০২)। পরে পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দে । লেখক একে প্যারোডি বললেও এটি আসলে তীব্র রবীন্দ্র বিদ্বেষে ভরা।
➤ ‘আনন্দ বিদায়’ ব্যর্থ রচনা । অভিনয়ের প্রথম রজনীতেই (স্টার থিয়েটারে) দর্শকের চাপে অভিনয় বন্ধ হয়ে যায় । দর্শকের হাতে নাট্যকার নিজেও নিগৃহীত হন ।

পৌরাণিক নাটকঃ
১. 'পাষানী' (১৯০০)
২. ‘সীতা’ (১৯০৮)
৩. 'ভীষ্ম' (১৯১৪)

➤ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রথম পৌরানিক নাটক ‘পাষাণী’ (১৯০০)। এই নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্র- ইন্দ্র, বিশ্বমিত্র, অসতী, চিরঞ্জীব, মাধুরী প্রমুখ । অহল্যার মানবিক কামনা বাসনা এখানে গুরুত্ব পেয়েছে ।
➤ 'সীতা' (১৯০৮) দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের শ্রেষ্ঠ পৌরানিক নাটক । রামায়ণের ‘উত্তর কান্ড’ ও ‘ভবভূতির উত্তর রামচরিত’ থেকে কাহিনী সংগ্রহ করে ‘সীতা’ (১৯০৮) নাটকটি রচিত হয় ।
➤ মহাভারতের বিষয়কে অবলম্বন করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচনা করেন ‘ভীম' (১৯১৪) । এই নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্র - বিচিত্রবীর্য, অম্বিকা, অম্বালিকা প্রমুখ ।

ইতিহাসাশ্রিত রোমান্টিক নাট্যকাব্যঃ
১. ‘তারাবাঈ’ (১৯০৩)
২. ‘সোরাব রুস্তম’ (১৯০৮)

➤ ‘তারাবাঈ’ (১৯০৩) দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রথম ঐতিহাসিক নাটক ।
➤ নাটকের মূল বৃত্তান্ত টডের রাজস্থানের ইতিহাস থেকে গৃহীত ।
➤ ‘সোরাব রুস্তম’ (১৯০৮) ফিরদৌসির 'শাহনামা' গ্রন্থ অবলম্বনে রচনা করেন ।

ঐতিহাসিক নাটকঃ
১. ‘প্রতাপসিংহ' (১৯০৫)
২. ‘দুর্গাদাস’ (১৯০৫)
৩. 'নূরজাহান' (১৯০৮)
৪. ‘মেবার পতন' (১৯০৮)
৫. ‘সাজাহান’ (১৯০৯)
৬. 'চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১)
৭. ‘সিংহল বিজয়’ (১৯১৪)

➤ ‘দুর্গাদাস’ হল দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক । এই নাটকের মূল উৎস – কর্নেল টডের 'Annals and Antiquities of Rajasthan' |
➤ রাজস্থানের ইতিবৃত্ত নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় নাট্য রচনা শুরু করেছিলেন, ‘মেবার পতন’ (১৯০৮) সেই ধারার শেষ নাটক । এই নাটকে চারণীদের কন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে- • “কিসের শোক করিস রে ভাই, আবার তোরা মানুষ হ’ ।
➤ ‘সাজাহান’ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচনা । এই নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্র সাজাহান, জাহানারা, মহামায়া ইত্যাদি। এই নাটকে চারণীদের কন্ঠ্যে ধ্বনিত হয়েছে -- “ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদেরএই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা “
➤ পুরাণ ও গ্রীস ইতিহাস থেকে উপাদান সংগ্রহ করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১) নাটক রচনা করেন। নাটকটি পঞ্চাঙ্ক নাটক ।
➤ ‘সিংহল বিজয়’ (১৯১৪) বিজয় সিংহের লঙ্কা জয়ের কাহিনীকে অবলম্বন করে রচিত ।


সামাজিক নাটকঃ
১. ‘পরপারে’ (১৯১২)
২. ‘বঙ্গনারী' (১৯১৬)

➤ ‘পরপারে’ নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় মাতৃভক্ত মহিমের কাহিনীকে উপস্থাপিত করেছেন । মহিম মাতৃভক্ত হয়েও স্ত্রীর কথা মত মা’কে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে ।
➤ ‘বঙ্গনারী’ (১৯১৬) নাটকে পণপ্রথা ও বাল্যবিবাহের কুফল বর্নিত । এই নাটকে গিরিশ ঘোষের প্রভাব যথেষ্ট । এই নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্র -- কেদার, সদানন্দ, সুশীলা।

* অন্যান্য বিষয় :
 দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রথম কাব্য 'আর্যগাথা’ (১৮৮২-৯৩)। এছাড়া ‘আষাঢ়ে’, ‘হাসির গান’, ‘মন্ত্র’, ‘আলেখ্য’, ‘ত্রিবেণী’ ইত্যাদি । “আষাঢ়ে’ ব্যঙ্গকাব্যের অনুসরনে রচিত। 'হাসির গান’ কাব্যটি বারহামের “Ingoldsby Legends' এর দ্বারা অনুভাবিত।
➤ ইংল্যান্ডে থাকাকালীন ১৮৮৬ সালে প্রকাশিত হয় তার একমাত্র ইংরাজি কাব্যগ্রন্থ ‘Lyrics of Ind’ ।
➤ ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকার সম্পাদক হিসাবে প্রথম সংখ্যার সূচনা অংশ লিখে দিয়েছিলেন । তবে পত্রিকাটি প্রকাশের তিনমাস আগেই তিনি মারা যান ।
➤ দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কাব্য সংক্রান্ত প্রবন্ধ হলঃ 'কাব্যের অভিব্যক্তি’ (১৩০১ কার্তিক ‘প্রবাসী’), ‘কাব্যের উপভোগ’ (১৩১৪ মাঘ ‘বঙ্গদর্শন'), 'কাব্যের নীতি' (১৩১৬ জ্যৈষ্ঠ ‘সাহিত্য')।

‘আনন্দবিদায়' নাটকটির সংক্ষেপঃ
        দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (ডি. এল. রায়)-এর লেখা। 'আনন্দ বিদায়' (১৯১২) রঙ্গ-প্রহসনটি রচনা করে দ্বিজেন্দ্রলাল রবীন্দ্রনাথকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে রুচিবান পাঠক ও দর্শকের দ্বারা ভর্ৎসিত হয়েছিলেন। ব্যক্তিগত এবং কুরুচিপূর্ণ আক্রমণের জন্য প্রহসন হিসেবে 'আনন্দবিদায়' সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। 

দ্বিজেন্দ্রলালের পৌরাণিক নাটকগুলির বৈশিষ্ট্যঃ
        দ্বিজেন্দ্রলালের পৌরাণিক নাটকগুলিতে পৌরাণিক কাহিনিকে নতুনভাবে উপস্থিত করার চেষ্টা দেখা যায়। পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষার জন্যই তিনি ভক্তিরসে পূর্ণ পৌরাণিক কাহিনিকে খানিকটা আধুনিক ছাঁচে ঢেলে নিয়েছেন। ফলে পৌরাণিক চরিত্রে আধুনিক যুগের ভাববৈশিষ্ট্য, বিশেষত ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য সংযুক্ত হয়েছে।

দ্বিজেন্দ্রলালকে সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক নাট্যকার বলার কারণঃ
        ঐতিহাসিক মূল্যে ও নাটকীয় উৎকর্ষে দ্বিজেন্দ্রলালের শ্রেষ্ঠ কীর্তি ঐতিহাসিক নাটকগুলি। রাজপুত বীরত্ব ও মুঘলযুগের কাহিনিগুলিতে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের সঙ্গে নাটকীয়তা সৃষ্টি করেছেন। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের রৌদ্ররসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাঁর ঐতিহাসিক নাটকগুলি রচিত হলেও সমসাময়িকঘটনা ও জনরুচির তাড়নায় তিনি প্রায় কোথাও ইতিহাসকে বিকৃত করেননি। নাটকে ইতিহাসের আনুগত্য আছে। ঐতিহাসিক নাটক স্বদেশপ্রেমের উঁচু সুর বাঁধা। তাই সংগত কারণেই দ্বিজেন্দ্রলালকে সর্বশ্রেষ্ঠ ঐতিহাসিক নাট্যকার বলা হয়।

দ্বিজেন্দ্রলালের ‘মেবার পতন' রচনার উৎসঃ
        দ্বিজেন্দ্রলালের বিখ্যাত ঐতিহাসিক নাটক ‘মেবার পতন’-এর কাহিনি জেমস টডের 'Annal and Antiquities of Rajasthan' নামক ঐতিহাসিক গ্রন্থ থেকে গৃহীত।

‘মেবার পতন’ নাটকের মূলভাবঃ
        ‘মেবারপতন’ (১৯০৮) নাটকে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রাজপুত ইতিহাসের কাহিনি বিবৃত করেছেন। অবশ্য রাজপুত ও মুসলমান সম্রাটদের সংঘর্ষই নাটকটির বিষয়বস্তু। 

‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকটির মূলভাবঃ 
        ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১) দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক। হিন্দু যুগ অবলম্বনে নাটকটি লেখা হলেও আসল আকর্ষণ মুঘল ও রাজপুত যুগের প্রতি। চাণক্যের চরিত্র নাটকের অমর সৃষ্টি।

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘নূরজাহান’ ও ‘সাজাহান’ নাটকের পটভূমিঃ 
        ভারতবর্ষের সিংহাসনকে কেন্দ্র করে নানাধরনের স্বার্থ সংঘাত এবং ক্ষমতাদ্বন্দ্বের যে বিচিত্র ইতিহাস মুসলমান আমলে গড়ে উঠেছিল এবং যে পটভূমির মধ্যে মানবিক প্রবৃত্তির যে বেদনা মিশ্রিত পরিণতি দেখা গেছে, দ্বিজেন্দ্রলাল তারই আলেখ্য রচনা করেছেন 'নূরজাহান’ ও ‘সাজাহান' নাটকে।


No comments