ক্ৰান্তদর্শী কবিমনীষী কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্য জীবনীকার হিসাবে শুধু শ্রেষ্ঠ নয়, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে একজন অন্যতম দার্শনিক কবি। সুগভীর প...
ক্ৰান্তদর্শী কবিমনীষী কৃষ্ণদাস কবিরাজ চৈতন্য জীবনীকার হিসাবে শুধু শ্রেষ্ঠ নয়, মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে একজন অন্যতম দার্শনিক কবি। সুগভীর পাণ্ডিত্য, অসাধারণ দার্শনিকতা ও ভক্তিশাস্ত্রে অতন্দ্ৰ নিষ্ঠা তাঁকে মধ্যযুগের অন্যতম কবির মর্যাদা দিয়েছে। গৌড়, উৎকল, বৃন্দাবন তথা দক্ষিণ ভারতের ভক্তিধর্ম ও দার্শনিকতাকে তিনি যেভাবে রূপ দিয়েছেন তাতে তাঁকে মধ্যযুগের ভারতীয় সাহিত্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী বলতেই হয়।
জন্ম পরিচয়ঃ
কবির জন্ম বর্ধমান জেলার কাটোয়ার কাছে ঝামটপুর গ্রামে। তিনি সম্ভ্রান্ত বৈদ্যবংশজাত। তাঁর পিতা ভগীরথ, মা সুনন্দা দেবী। কবি ছিলেন নিত্যানন্দের শিষ্য। গুরু নিত্যানন্দের দ্বারা স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে তিনি বৃন্দাবনে চলে যান এবং সেখানে বৈষ্ণব মহাজনদের কাছে ভক্তি শাস্ত্রাদি অধ্যয়ন করেন। কৃষ্ণদাসের জন্মকাল নিয়ে মতভেদ আছে ঃ
(i) বিমানবিহারী মজুমদারের মতে কবির জন্মকাল ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে।
(ii) জগদ্বন্ধু ভদ্র ও সতীশচন্দ্র রায়ের মতে কৃষ্ণদাসের জন্ম ১৪৯৬ খ্রিস্টাব্দ।
কাব্য পরিচয়ঃ
কৃষ্ণদাস কবিরাজের গ্রন্থের নাম ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ । বাংলা ভাষায় রচিত শ্রেষ্ঠ চৈতন্য জীবনী গ্রন্থ এটি ।
অন্যান্য কাব্যঃ
কৃষ্ণদাস কবিরাজের লেখা দুটি সংস্কৃত কাব্য পাওয়া গিয়েছে। একটি কৃষ্ণকর্ণামৃতের টীকা ‘সারঙ্গরঙ্গদা' এবং অপরটি ‘গোবিন্দলীলামৃত' মহাকাব্য।
কাব্য রচনার উদ্দেশ্যঃ
অপ্রকট অন্তরঙ্গ-লীলার প্রত্যক্ষ প্রকটনই কৃষ্ণদাস কবিরাজের গ্রন্থরচনার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল। বৃন্দাবনবাসী মহাজনগণের নির্দেশে, তাঁদেরই আকুতি চরিতার্থ করার আকাঙ্ক্ষায়, কৃষ্ণদাস চৈতন্যজীবন রচনায় লেখনী ধারণ করেছিলেন।
রচনাকালঃ
কৃষ্ণদাসের গ্রন্থ রচনাকাল সম্পর্কে মতভেদ রয়েছে।
(i) সুকুমার সেনের মতে ১৫৬০-৮০ খ্রিস্টাব্দ গ্রন্থটির রচনাকাল।
(ii) অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করেন ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দের পর কৃষ্ণদাস কাব্য রচনায় হস্তক্ষেপ করেন। কৃষ্ণদাস সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে কাব্যটি সমাপ্ত করেন।
(iii) সম্রাট আকবরের সময়ে ১৫৯০ খ্রিস্টাব্দে বৃন্দাবনের গোবিন্দ মন্দির নির্মাণের পর কবি শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত রচনার কাজে হাত দেন।
খন্ড বিভাগঃ
‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের রচয়িতা- কৃষ্ণদাস কবিরাজ। কাব্যের তিনটি লীলা –
ক) আদিলীলা - সতেরটি পরিচ্ছেদে প্রথম নয়টিতে বৈষ্ণবতত্ত্ব, বাকী পরিচ্ছেদে জন্ম থেকে সন্ন্যাস বর্ণিত ।
খ) মধ্যলীলা - পচিশটি পরিচ্ছেদে সন্ন্যাসগ্রহন, নীলাচলে আগমন, দাক্ষিনাত্য ভ্রমন, রামানন্দের সঙ্গে তত্ত্বালোচনা, পুরীতে রথযাত্রায় নৃত্য ইত্যাদি বর্ণিত ।
গ) অন্ত্যলীলা- কুড়িটি পরিচ্ছেদে দিব্যোম্মাদ আবস্থা
কাব্যের গঠনঃ
কৃষ্ণদাস কবিরাজ তিনটি খণ্ডে ৬২টি অধ্যায়ে তার কাব্য বিভক্ত করেছেন।
আদি খণ্ডে - ১৭টি অধ্যায়ে চৈতন্যের সন্ন্যাস গ্রহণের সময় পর্যন্ত কাহিনী বর্ণিত।
মধ্য খণ্ডে - ২৫টি অধ্যায়ে রায় রামানন্দের সঙ্গে সাধ্যসাধন সম্পর্কিত আলোচনা, রূপ সনাতনের সঙ্গে চৈতন্যের সাক্ষাৎকার, প্রকাশানন্দের সঙ্গে চৈতন্যের তর্কযুদ্ধ ও প্রকাশানন্দের পরাভব প্রভৃতি ঘটনা বর্ণিত।
অন্ত্য খণ্ডে - ২০টি অধ্যায়ে শ্রীচৈতন্যের শেষ বার বৎসরের দিব্যোন্মাদ অবস্থার বর্ণনায় কবির কলম স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে উঠেছে। সমুদ্রে পতন ও উদ্ধার ইত্যাদি বর্ণিত ।
কাব্যের গুরুত্বঃ
কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত কাব্যের গুরুত্ব হল –
ক) গৌড়ীয় বৈষ্ণব দর্শনের নিপুন তত্ত্বকথা অর্থাৎ রাধাতত্ত্ব, কৃষ্ণতত্ত্ব, অচিন্ত্যভেদাভেদতত্ত্ব ইত্যাদি বর্ণিত।
খ) চৈতন্যদেবের অন্ত্যজীবনের প্রামান্য দলিলরূপে স্বীকৃত।
চৈতন্য ভাগবত ও চৈতন্যচরিতামৃতের পার্থক্যঃ
(a) ‘চৈতন্যভাগবত’ এ মুখ্যত চৈতন্যের প্রথম চব্বিশ বছরের জীবন অর্থাৎ নবদ্বীপলীলা বর্ণিত । শ্রী চৈতন্যচরিতামৃত’ এ চৈতন্যের পরবর্তী চব্বিশ বছরের জীবন অর্থাৎ বৃন্দাবনলী বর্ণিত ৷
(b) `চৈতন্যভাগবত'-এ চৈতন্যের একান্ত ঘরোয়ারূপ, ‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত'-এ চৈতন্যের সর্বভারতীয় রূপ ।
‘শ্রীচৈতন্যচরিতামৃতে’র স্বীকৃতিঃ
শ্রীচৈতন্যের জীবনী রচনা কৃষ্ণদাসের উদ্দেশ্য ছিল না। তাই 'চৈতন্যচরিতামৃত' সুবৃহৎ জীবনীকাব্যে চৈতন্যের অধ্যাত্ম আদর্শকেই যথাযথ ফুটিয়ে তুলেছেন। জীবনী ও দর্শনের যুগপৎ সমন্বয়ে “চৈতন্যচরিতামৃত' অপরূপ গ্রন্থ হয়ে উঠেছে এবং ভক্ত, তাত্ত্বিক ও ভাবুকদের কাছে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
আদি লীলার গুরুত্বঃ
‘চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের আদিলীলা পর্বটি সবিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে । কারণ --
(ক) এই পর্বে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় বৃন্দাবনের গোস্বামী সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যায় বৈষ্ণবধর্ম দর্শন ও রসতত্ত্ব বিশ্লেষিত, বিবৃত ও আলোচিত।
(খ) জীব-উদ্ধারের জন্য চৈতন্যাবতারের প্রয়োজনীয়তা—বৃন্দাবন দাসের মতো এই তত্ত্ব স্বীকার করেও কৃষ্ণদাস রাধাকৃষ্ণের যুগলতনুরূপে চৈতন্যাবির্ভাবের তত্ত্বটির প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন।
(গ) চৈতন্যদেব ও তাঁর বিভিন্ন ভক্তদের শাখা নির্ণয় এবং পরিচয় দিয়ে তিনি বৈষ্ণবধর্ম ও সমাজের ক্রমবিকাশের স্তর-পরম্পরা দেখিয়েছেন।
(ক) এই পর্বে সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় বৃন্দাবনের গোস্বামী সম্প্রদায়ের ব্যাখ্যায় বৈষ্ণবধর্ম দর্শন ও রসতত্ত্ব বিশ্লেষিত, বিবৃত ও আলোচিত।
(খ) জীব-উদ্ধারের জন্য চৈতন্যাবতারের প্রয়োজনীয়তা—বৃন্দাবন দাসের মতো এই তত্ত্ব স্বীকার করেও কৃষ্ণদাস রাধাকৃষ্ণের যুগলতনুরূপে চৈতন্যাবির্ভাবের তত্ত্বটির প্রতি বেশি গুরুত্বারোপ করেছেন।
(গ) চৈতন্যদেব ও তাঁর বিভিন্ন ভক্তদের শাখা নির্ণয় এবং পরিচয় দিয়ে তিনি বৈষ্ণবধর্ম ও সমাজের ক্রমবিকাশের স্তর-পরম্পরা দেখিয়েছেন।
‘চৈতন্যচরিতামৃতম’ ভক্তি সাধনার জীবন বেদ’
ভাবুক বৈশ্তবের দৃষ্টিতে ‘চৈতন্যচরিতামৃত ভক্তিসাধনার জীবনবেদ'। চৈতন্য-জীবনরসের তথ্যাতীত সত্যস্বরূপ তাতে ভাস্বর; কৃষ্ণদাসও দার্শনিকের দৃষ্টি নিয়ে শ্রীচৈতন্যের এমন অনেক লীলা লিখেছেন, যা অপ্রকট লীলায় সত্য। এইভাবেই বৈষ্ণবগণ এতাবৎকাল চৈতন্যচরিতামৃতকে আস্বাদন করে আসছেন।
অলৌকিক ঘটনাঃ
‘চৈতন্যচরিতামৃত' গ্রন্থের আদিলীলায় আম্রভক্ষণলীলা, মধ্যলীলায় বৌদ্ধ পণ্ডিতের মাথা কাটা যাওয়া ও পুনরুজ্জীবন, কাশী মিশ্র ও প্রতাপ রুদ্রকে চতুর্ভুজ মূর্তি বা ঐশ্বর্য দেখানো, অর্ন্তলীলায় ভাবাবেশে শ্রীচৈতন্যের এক একখানি পত্র দেড় গজ দীর্ঘ হওয়া, তিন দ্বারে কপাট লাগানো থাকা সত্ত্বেও প্রভুর বার হয়ে যাওয়া প্রভৃতি অলৌকিক ঘটনা বর্ণিত।
কবির কবিত্ব শক্তিঃ
কৃষ্ণদাস কবিরাজ মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান কৃতবিদ্য কবি। বৈষুবীয় ধর্মাদর্শে দীক্ষিত হয়েও তিনি নীরস তত্ত্বদর্শনকে কবিতার রসাশ্রিত করে তুলেছেন। তাঁর কাব্যে গীতিমূৰ্চ্ছনা না থাকলেও দুরূহ জটিল তত্ত্বকথা একান্ত সরল সহজ ও ঋজু হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষ্ণদাসের কাব্য বৈষ্ণব দর্শনকে উপলব্ধি করার দর্পণ স্বরূপ। তাঁর কবিত্বশক্তির গুণে পরিমিত বাক্যবিন্যাস, ভক্তিতন্ময়তা ও অলংকারের সমন্বয়ে চৈতন্যচরিতামৃত দর্শন ও কাব্যের যুক্তবেণি রচনা করেছে।
|
এক নজরে
কৃষ্ণদাস কবিরাজ |
1. সর্বশ্রেষ্ঠ চৈতন্য জীবনী কাব্যের নাম ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ।
2. চৈতন্যচরিত সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি কৃষ্ণদাস কবিরাজ ।
3. ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থের লেখক কৃষ্ণদাস কবিরাজ ।
4. কৃষ্ণদাস কবিরাজ ষোড়শ শতকের প্রথমার্ধে বর্ধমান জেলার কাটোয়ার নিকটবর্তী ঝামটপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন ।
5. কৃষ্ণদাস কবিরাজের পিতা - ভগীরথ, মাতা - সুনন্দা ।
6. নিত্যানন্দের স্বপ্নাদেশ লাভ করে কৃষ্ণদাস কবিরাজ গৃহ ত্যাগ করে বৃন্দাবন ধামে উপস্থিত হন ।
7. কৃষ্ণদাস কবিরাজ নিত্যানন্দ দাসের শিষ্যত্ব গ্রহন করেন ।
8. কৃষ্ণদাস কবিরাজকে ‘কবিভূপতি’ উপাধি দেন নিত্যানন্দ দাস ।
9. ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ ৩টি লীলায় বিভক্ত ( কবি ‘খন্ড’ শব্দের বদলে ‘লীলা’ শব্দ ব্যবহার করেছেন )।
10. গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে শ্রীরূপ গোস্বামী ও জীব গোস্বামীর নাম আছে ।
11. কৃষ্ণদাস কবিরাজের গ্রন্থে চৈতন্য জীবনের অন্ত্যপর্ব বর্নিত হয়েছে ।
12. কৃষ্ণদাস কবিরাজের সংস্কৃত কাব্যের নাম কৃষ্ণনামৃতের টীকা ‘সারঙ্গরঙ্গদা’ এবং ‘গৌবিন্দলীলামৃত’ কাব্য।
13. কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থটিকে গৌড়ীয় বৈষœব দর্শনের রসভাস্য বলা হয় ।
14. ‘অসরজ্ঞ কাক চুষে জ্ঞান নিস্বফল / রসজ্ঞ কোকিল চুষে প্রেমাম্ভ্র মুকুল ।” - কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত’ গ্রন্থে এই উক্তি করা হয়েছে ।
15. এই গ্রন্থে ‘অচিন্তভেদাভেদতত্ত¡’ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।

No comments