মধুসূদনের হাতে বাংলা গীতিকবিতার উদ্ভব হলেও তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা বিহারীলালের কবিতায় আমরা পাই। বাংলা সাহিত্যে গীতিকবিতার অভাব পূরণের জন্...
মধুসূদনের হাতে বাংলা গীতিকবিতার উদ্ভব হলেও তার পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠা বিহারীলালের কবিতায় আমরা পাই। বাংলা সাহিত্যে গীতিকবিতার অভাব পূরণের জন্যই যেন বিহারীলালের আবির্ভাব ঘটে। বিহারীলালই বাংলার প্রথম দ্বিধাহীন গীতিকবি। রবীন্দ্রনাথ বিহারীলালকে বলেছিলেন 'প্রত্যুষের শুকতারা' বিহারীলাল 'ভোরের পাখি' বলেও আমরা জানি।
পরিচয়ঃ
কলকাতার জোড়াবাগান অঞ্চলে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ২১শে মে বিহারীলাল চক্রবর্তী জন্মগ্রহন করেন । পিতা -দীননাথ চক্রবর্তী, পুরোহিত ছিলেন। ১৯ বছর বয়সে ১০ বছর বয়সী অভয়াদেবী কে প্রথম বিবাহ করেন। ৪ বছর পর অভয়াদেবী মারা যান। তার ২ বছর পর নবীনচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের ২য় কন্যা কাদম্বিনী দেবীকে বিবাহ করেন। ১৮৯৪ খ্রিস্টাব্দে ২৪শে মে বহুমুত্র রোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি দেহত্যাগ করেন।
তথ্যাবলীঃ
(a) বিহারীলাল এই নাম সম্পর্কে সুকুমার সেন তাঁর ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন - “ইনি স্বাক্ষর করিতেন বেহারীলাল”।
(b) সুকুমার সেনের মতে “আধুনিক বাঙ্গালা অন্তরঙ্গ গীতিকাব্যের প্রবর্তক তিনিই”।
(c) বিহারীলাল চক্রবর্তীর ভাবশিষ্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ‘ভোরের পাখি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
প্রথম রচনাঃ
বিহারীলাল চক্রবর্তীর প্রথম রচনা ‘স্বপ্নদর্শন’(১৮৫৮) নামক গদ্য গ্রন্থ। সংস্কৃত কলেজে পাঠরত অবস্থায় তিনি এই গ্রন্থটি রচনা করেন। তবে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘সঙ্গীতশতক’(১৮৬২)।
শ্রেষ্ঠ রচনাঃ বিহারীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘সারদামঙ্গল’(১৮৭৯)।
১. সঙ্গীত শতক (১৮৬২)
২. বঙ্গসুন্দরী (১৮৭০)
৩. নিসর্গসন্দর্শন (১৮৭০)
৪. বন্ধুবিয়োগ (১৮৭০)
৫. প্রেমপ্রবাহিনী (১৮৭০)
৬. সারদামঙ্গল (১৮৭৯)
৭. মায়াদেবী (১৮৮২)
৮. বাউল বিংশতি (১৮৮৭)
৯. সাধের আসন (১৮৮৯)
১০. গোধূলি (১৮৯৯)
১১. ধুমকেতু
১২. শরৎকাল
১৩. দেবরানী
১৪. কবিতা ও সংগীত
পত্রিকায় প্রকাশিত রচনা :
(a) ‘স্বপ্নদর্শন’ ➡ ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকা
(b) ‘বন্ধুবিয়োগ’ ➡ ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকা
(c) ‘নিসর্গসন্দর্শন’ ➡ ‘অবোধবন্ধ ‘ পত্রিকা
(d) ‘প্রেমপ্রবাহিনী’ ➡ ‘অবোধবন্ধু’ পত্রিকা
(e) ‘সারদামঙ্গল’ ➡ ‘আর্যদর্শন’ পত্রিকা।
আলোচনাঃ
‘স্বপ্নদর্শন’ (১৮৫৮):
➤ বিহারীলালের প্রথম রচনা 'স্বপ্নদর্শন' (১৮৫৮) নামক গদ্যগ্রন্থ।
➤ সংস্কৃত কলেজে পাঠরত অবস্থায় কবি এই গ্রন্থ রচনা করেন ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায়।
➤ 'সংবাদ প্রভাকর' পত্রিকা (১৮৫৮, ৩রা আগষ্ট) এই গদ্যগ্রন্থের প্রশংসা করে।
➤ গ্রন্থটির বিষয় ছিল দেশ ও দেশমাতৃকার দুর্ভাগ্যের জন্য গভীর আক্ষেপ।
‘সঙ্গীত শতক’ (১৮৬২):
➤ এটি কবির দ্বিতীয় গ্রন্থ ।
➤ ১৮৬২ খ্রিষ্টাব্দে কাব্যটি প্রকাশিত হয় ।
➤ গ্রন্থটি একশত বাংলা গানের সমষ্ঠি ।
➤ গ্রন্থটি দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল ।
‘বঙ্গসুন্দরী’ (১৮৭০):
➤ কাব্যটি ১০ টি সর্গে বিভক্ত।
➤ প্রথম সংস্করণে ছিল ৯ টি সর্গ।
➤ দ্বিতীয় সংস্করণে আরও একটি সর্গ ‘সুরবালা’ সংযোজিত হয়।
➤ এই দশটি সর্গ হল -- ‘উপহার’, ‘নারীবন্দনা’, ‘সুরবালা’, ‘চিরপরাধিনী’, ‘করুণা সুন্দরী’, ‘বিষাদিনী’, ‘প্রিয়সখী’, ‘বিরহিনী’, ‘প্রিয়তমা’ এবং ‘অভাগিনী’ ।
➤ প্রত্যেকটি সর্গের প্রারম্ভে ভবভূতি, কালিদাস, বায়রনের একটি করে উদ্ধৃতি রয়েছে ।
‘বন্ধুবিয়োগ’ (১৮৭০):
➤ কাব্যটি প্রথমে ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
➤ ৪টি সর্গে রচিত শোককাব্য।
➤ সর্গগুলি হল --- ‘পূর্ণ বিজয়’, ‘কৈলাস’, ‘সরলা’, ‘রামচন্দ্র’ ।
➤ কাব্যে তাঁর ৪ বন্ধু -- পূর্ণচন্দ্র, কৈলাস, বিজয় ও রামচন্দ্র এবং তাঁর প্রথমা পত্নী অভয়াদেবীর বিয়োগ ব্যাথা ব্যক্ত করেছেন।
‘নিসর্গসন্দর্শন’ (১৮৭০):
➤ কাব্যটি ধারাবাহিকভাবে ‘অবোধবন্ধু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
➤ কাব্যটি সাতটি সর্গে বিভক্ত ।
➤ সর্গগুলি হল --- ‘চিন্তা’, ‘সমুদ্র দর্শন’, ‘বীরাঙ্গনা’, ‘নভোমন্ডল’, ‘ঝটিকার রজনী’, ‘ঝটিকা সম্ভোগ’, এবং ‘প্রভাত’ ।
➤ কাব্যের দ্বিতীয় সর্গ ‘সমুদ্র দর্শন’ পুরীর সমুদ্র দর্শনের পর লেখা।
‘প্রেমপ্রবাহিনী’ (১৮৭০):
➤ কাব্যটি ‘অবোধবন্ধু’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
➤ ৫টি সর্গে কাব্যটি রচিত।
➤ সর্গগুলি হল ‘পতন’, ‘বিরাগ’,‘বিষাদ’,‘অন্বেষণ’,‘নির্বান’।
‘সারদামঙ্গল' (১৮৭৯) ঃ
➤ বিহালীলাল চক্রবর্তীর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘সারদামঙ্গল’(১৮৭৯)।
➤ কাব্যগ্রন্থটি ৫টি স্বর্গে বিভক্ত।
➤ মৈত্রী বিরহ, প্রীতি বিরহ এবং সরস্বতী বিরহ -- এই ত্রিবিধ বিরহই ‘সারদামঙ্গল’ রচনার মূল উৎস কবি একথা স্বীকার করেছেন।
➤ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় - “সারদামঙ্গল এক অপরূপ কাব্য”।
➤ ‘ঊষা’ বন্দনা দিয়ে কাব্যের শুরু -- “চরণ কমলে লেখা আধ আধ রবি রেখা / সর্বাঙ্গে গোলাপ আভা, সীমান্তে শুকতারা জ্বলে।”
➤ তাঁর এই কাব্যে প্রখ্যাত ইংরেজী কবি শেলী-র “Hyme to Intellectual Beauty” কবিতার সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
➤ মৈত্রী বিরহ, প্রীতি বিরহ এবং সরস্বতী বিরহ -- এই ত্রিবিধ বিরহই ‘সারদামঙ্গল’ রচনার মূল উৎস কবি একথা স্বীকার করেছেন।
➤ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় - “সারদামঙ্গল এক অপরূপ কাব্য”।
➤ ‘ঊষা’ বন্দনা দিয়ে কাব্যের শুরু -- “চরণ কমলে লেখা আধ আধ রবি রেখা / সর্বাঙ্গে গোলাপ আভা, সীমান্তে শুকতারা জ্বলে।”
➤ তাঁর এই কাব্যে প্রখ্যাত ইংরেজী কবি শেলী-র “Hyme to Intellectual Beauty” কবিতার সাদৃশ্য পাওয়া যায়।
‘সাধের আসন' (১৮৮৯) ঃ
➤ কাব্যটি ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে রচিত ।
➤ কাব্যগ্রন্থটি ১০টি স্বর্গে বিভক্ত।
➤ কাদম্বিনী দেবী সারদামঙ্গলের অনুরক্ত পাঠিকা ছিলেন। ইনি কবিকে একটি পশমের আসন বুনিয়া দিয়াছিলেন, তাহাতে সারদামঙ্গলের এই কয় ছত্র তোলা ছিল—
‘‘হে যোগেন্দ্র! যোগাসনে
ঢুলুঢুলু দুনয়নে বিভোর বিহ্বল মনে কাঁহারে ধেয়াও? ”
--- কবি এই প্রশ্নের উত্তর স্বরূপ কাব্যটি লেখেন ।
➤ এই গ্রন্থটিকে ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যের উপসংহার বলা হয় ।
➤ কাব্যটি কাদম্বরী দেবীকে উৎসর্গ করেন ।
ভোরের পাখি বলার কারণঃ
ভোরের পাখি শান্ত, স্নিগ্ধ, মধুর ও রোমান্টিক । সে তার আপন কুজনে সূর্যের মাঙ্গলিক আগমন বার্তা ঘোষণা করে । ঠিক তেমনি বিহারীলাল চক্রবর্তী তাঁর কবিতায় নিজ হ্রদয়ের উচ্ছ্বাস ও মধুর ভাবকে ব্যক্ত করে বাংলা গীতি কবিতার দ্বারকে উন্মোচন করে গীতিকবিতার জয়যাত্রা সূচনা করেন ।
তাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘অবোধবন্ধু’ পত্রিকায় বিহারীলাল চক্রবর্তীকে আধুনিক গীতিকবিতার ‘ভোরের পাখি’ বলে অভিহিত করেছেন ।
বাংলা গীতিকবিতায় বিহারীলাল চক্রবর্তীর অবদান :
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীনচন্দ্র সেনের তুলনায় বিহারীলালের কবিখ্যাতি কিছু কম ছিল না। কিন্তু আধুনিক বাংলা গীতিকবিতার যে বৈশিষ্ট্য, ঐশ্বর্য রবীন্দ্রপ্রতিভার দানে আমাদের সমৃদ্ধ করে তুলেছে তার পূর্বসূচনা একমাত্র বিহারীলাল চক্রবর্তীর কাব্যেই দেখা যায়।
বিহারীলালের গীতিকবিতা জনমানসে জনপ্রিয় না হওয়ার কারণঃ
(ক) বিহারীলাল মাঝে মাঝে এতটা আত্ননিষ্ঠ হয়ে পড়তেন যে তাঁর ব্যক্তিগত উপলব্ধি; সাধারণ পাঠকের কাছে দুর্বেদ্ধি ঠেকত।
(খ) তিনি যতবড় ভাবুক ছিলেন, ততবড় কবি ছিলেন না।
(গ) ছন্দ - অলংকার - শব্দের ঐশ্বর্যময়তা তাঁর কাব্যে ছিল না ।
(ঘ) তিনি নিজের ব্যক্তিগত উপলব্ধি প্রকাশ করেই ক্ষান্ত ছিলেন ।
বিহারীলাল চক্রবর্তীকে ঊনবিংশ শতাব্দীর গীতিকবিদের গুরুস্থানীয় বলার কারণঃ
বিহারীলালের পূর্বে বাংলা কাব্যে গীতিকবিতার যথার্থ সুর শ্রুত হয়নি। গীতিকবিতা – যা মূলতঃ পাশ্চাত্য ভাবধারার অঙ্গ তার প্রথম সূচনা বিহারীলালেই প্রত্যক্ষ। এই কারণে ঊনবিংশ শতাব্দীর গীতিকাররা, যেমন সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার, অক্ষয় কুমার বড়াল, দেবেন্দ্রনাথ সেন এমনকি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত বিহারীলালকেই সাহিত্যের গুরু বলে মেনেছেন।

No comments