ইতিহাস ও সমাজের কাছে দায়বদ্ধতা যাঁর শিল্পীসত্তার উৎস, যিনি আজীবন শোষিত-বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষদের পাশে থেকেছেন, লোধা -সাঁওতাল-শবর-সহিস কির...
পরিচয় :
১৯২৬ সালে ব্রিটিশ ভারতের ঢাকা শহরে মহাশ্বেতা দেবী জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার বাবা মণীষ ঘটক ছিলেন কল্লোল সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামা কবি ও ঔপন্যাসিক। তিনি ‘যুবনাশ্ব’ ছদ্মনামে লিখতেন। বিজয়গড় কলেজে (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক অনুমোদিত কলেজ) শিক্ষকতা শুরু করেন। সেই সময় বিজয়গড় কলেজ ছিল শ্রমিক শ্রেণির ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এই সময় মহাশ্বেতা দেবী একজন সাংবাদিক ও একজন সৃজনশীল লেখক হিসেবেও কাজ চালিয়ে যান। তিনি পশ্চিমবঙ্গের লোধা ও শবর উপজাতি, নারী ও দলিতদের নিয়ে পড়াশোনা করেন। ১৯৬২ সালে বিজন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। সংসার ভেঙে গেলেও ছেলের জন্য খুব ভেঙে পড়েছিলেন। সেসময় তিনি অতিরিক্ত ঘুমের ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করতেও গিয়েছিলেন, চিকিৎসকদের চেষ্টায় বেঁচে যান। এরপর তিনি অসিত গুপ্তকে বিয়ে করেন ১৯৬৫ সালে, কিন্তু সেই সংসারও ১৯৭৬ সালে ভেঙে যায়। নিঃস্ব জীবন, বিচ্ছেদ-বিরহ-বেদনায় তিনি নিজেকে সঁপে দেন লেখা এবং শিক্ষার ব্রতে। শাল সাহিত্যাকাশ ছেড়ে মহাশ্বেতা দেবীর দূর অজনায় পাড়ি জমান ২০১৬ সালের ২৮ জুলাই। কীর্তিমানের মৃত্যু নাই - নিজ কর্মেবি তারই চিহ্ন রেখে গেছেন পাঠক, ভক্ত হৃদয়ে।
রচনাসমূহ :
মহাশ্বেতা দেবী ১০০টিরও বেশি উপন্যাস এবং ২০টিরও বেশি ছোটোগল্প সংকলন রচনা করেছেন। সেই সব রচনার মধ্যে অনেকগুলি অন্যান্য ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
প্রথম রচনা :
(a) খগেন্দ্রনাথ সেন সম্পাদিত 'রংমশাল' পত্রিকায় ১৯৩৯ সালে ‘রবীন্দ্রনাথের ছেলেবেলা' তাঁর প্রথম প্রকাশিত রচনা ।
(b) প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ ‘ঝাসির রাণী' (জীবনী) ১৯৫৬-তে।
(c) প্রথম মুদ্রিত উপন্যাস 'নটী' (১৯৫৭) প্রকাশিত হয়।
উপন্যাস :
- 'নটী' (১৯৫৭),
- 'মধুরে মধুর' (১৯৫৮),
- ‘যমুনা কী তীর’ (১৯৫৮),
- ‘তিমির লগন’ (১৯৫৯),
- ‘প্রেমতারা’ (১৯৫৯),
- ‘এইটুকু আশা' (১৯৫৯)
- "বায়োস্কোপের বাক্স' (১৯৬০),
- 'রূপরেখা' (১৯৬০),
- 'তারার আঁধার' (১৯৬০),
- 'লায়লা আসমানের আয়না' (১৯৬১),
- ‘পরম পিপাসা’ (১৯৬১),
- “সামনে তাকাও' (১৯৬১),
- 'অমৃত সঞ্চয়' (১৯৬২),
- 'দিনের পারাবারে' (১৯৬৩),
- ‘অজানা’ (১৯৬৫),
- ‘বাসস্টপে বর্ষা' (১৯৬৬),
- 'কবি বন্দাঘটি গাক্রির জীবন ও মৃত্যু' (১৯৬৬),
- 'আঁধার মাণিক' (১৯৬৬),
- 'বিপন্ন আয়না' (১৯৬৬),
- 'তীর্থশেষের সন্ধ্যা' (১৯৬৬),
- 'দুস্তর' (১৯৬৬),
- ‘মধ্যরাতের গান’ (১৯৬৭),
- 'স্বামীর ঘর' (১৯৬৮),
- ‘মাস্টার সাব’ (১৯৭২),
- ‘দুস্তর’ (১৯৭৫),
- 'হাজার চুরাশির মা' (১৩৮১ বঙ্গাব্দ)
- ‘জন্ম যদি তব’ (১৯৭৬),
- ‘ধানের শিষে শিশির' (১৯৭৬),
- 'স্বাহা' (১৯৭৭),
- 'অরণ্যের অধিকার’ (১৯৭৭),
- 'অপারেশন বসাই টুডু' (১৯৭৮),
- 'অগ্নিগর্ভ' (১৯৭৮),
- 'সরসতীয়া' (১৯৭৯),
- ‘সুভাগা বসন্ত' (১৯৮০),
- 'নৈঋতে মেঘ' (১৯৮০),
- 'জটায়ু' (১৯৮০),
- 'অক্লান্ত কৌরব' (১৯৮০),
- 'চোট্টি মুণ্ডা এবং তার তীর' (১৯৮০),
- ‘সিধু কানুর ডাকে' (১৯৮১),
- 'বিবেক বিদায় পালা’ (১৯৮৩),
- `শালগিরার ডাকে' (১৯৮৩),
- 'আশ্রয়' (১৯৮৫),
- 'তিতুমির’ (১৯৮৬),
- ‘বিশ-একুশ’ (১৯৮৬),
- “শ্রীশ্রী গণেশ মহিমা’ (১৯৮৭),
- ‘টেরোড্যাকটিল, পূরণ সহায় ও পিরথা' (১৯৯০)
- 'সতী' (১৯৯০),
- ‘ক্ষুধা' (১৯৯২),
- 'গান্ধারী পর্ব (১৯৯২),
- ‘মার্ডারারের মা’ (১৯৯২),
- 'ব্যাধখণ্ড' (১৯৯৭),
- ঊনত্রিশ নম্বর ধারার আসামী' (১৯৯৮)।
ছোটগল্প সংকলন :
- 'সোনা নয় রূপো নয়' (১৯৬০),
- 'সপ্তপণী' (১৯৬১),
- ‘অবিশ্বাস্য’ (১৯৭২),
- 'মূর্তি' (১৯৭৯),
- 'স্তনদায়িনী ও অন্যান্য গল্প' (১৯৭৯),
- 'পাকাল' (১৯৮৩),
- 'দৌলতি' (১৯৮৪),
- 'ইটের পর ইট' (১৯৮৭),
- 'কি বসন্তে কি শরদে (১৯৮৭),
- ‘প্রথম পাঠ’ (১৯৮৮),
- ‘ঘাতক’ (১৯৮৯),
- ‘তালাক ও অন্যান্য গল্প’ (১৯৯২) প্রভৃতি।
কিশোর গল্প সংকলন :
- 'গল্পের গরু ন্যাদেশ',
- 'হারে রে রে',
- 'বাঘা শিকারী',
- ‘জাতকের গল্প’,
- ‘মুনেশ্বর' প্রভৃতি।
আলোচনা :
(a) ‘ঝাঁসির রানি’ :
- তার প্রথম মুদ্রিত গ্রন্থ "ঝাঁসির রানি" ।
- এটি মূলত জীবনী গ্রন্থ ।
- লক্ষ্মীবাই এর জীবনী অবলম্বনে রচিত।
- এটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৬ সালে।
- এই উপন্যাসটি রচনার আগে তিনি ঝাঁসি অঞ্চলে গিয়ে তাঁর রচনার উপাদান হিসেবে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এনেছিলেন।
- লেখিকা এই গ্রন্থ প্রকাশের প্রসঙ্গে জানিয়েছেন,
“১৯৫০-এ আমরা সপরিবারে বোম্বে গিয়েছিলাম। বিজনের কাজ ছিল। সেখানে আমার বড়মামা শচিন চৌধুরীর বিশাল লাইব্রেরী থেকে সাভারকরের লেখা ‘১৮৫৭' নামে বইটি পড়ে ঝাঁসির রাণীর জীবন সম্পর্কে আগ্রহী হই। কলকাতায় এসে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিকদের সাহায্য নিয়ে এবং ন্যাশনাল লাইব্রেরীতে গিয়ে অনেকদিন ধরে টোটাল ওয়ার্কটি করি। তারপর মনে হয়, দেখা দরকার সেখানে রাণীর স্মৃতি কিভাবে বেঁচে আছে। তখন ছোট্ট ছেলেটিকে স্বামীর কাছে রেখে আমি ঝাসী, গোয়ালিয়র ইত্যাদি জায়গায় ঘুরে ঘুরে অনেক উপাদান সংগ্রহ করেছিলাম। তারই ভিত্তিতে লেখা”।
(b) ‘নটী’ :
- 'নটী' উপন্যাসের পটভূমি সিপাই বিদ্রোহ।
- এই বিদ্রোহের পটভূমিতে উপস্থাপিত হয়েছে ঝাঁসীর তোপখানার হাবিলদার খুদাবক্স ও রাজপরিবারের নটী মোতির প্রেম।
- একদিকে প্রেম ও রোমান্সের বর্ণনা এবং অন্যদিকে সামস্ততান্ত্রিক নবাবী বিলাস ও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের শাসন ও শোষণকে লেখিকা উপন্যাসে অঙ্কন করেছেন।
- ইংরেজ সাহেবদের সঙ্গে গরীব চাষীদের সম্পর্ক, শাসকের বিরুদ্ধে কৃষকদের লাঙল ছেড়ে অস্ত্র তুলে নেওয়া ও লড়াই করার চিত্র এঁকেছেন লেখিকা। ফলে উপন্যাসটি শুধু প্রেমের কাহিনি না হয়ে সাধারণ মানুষের জীবন ও জীবিকার ছবিও হয়ে ওঠে।
(c) ‘হাজার চুরাশির মা' :
- ‘হাজার চুরাশির মা' জনপ্রিয় রাজনৈতিক উপন্যাস।
- বাংলার বিশ শতকের সত্তর দশকের উত্তাল রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উপন্যাসটি রচিত।
- উপন্যাসটির উৎস সম্বন্ধে নিজেই জানিয়েছেন,
“ আমি তখন চুটিয়ে। গল্প লিখছি। সেই সময় দুটি ছেলে এসে আমায় বলেছিল, 'আমাদের কথা কে আর লিখবে? আমরা শহরের রাস্তায় এভাবে মরছি। নকশাল আন্দোলনের প্রতি আমি সহানুভূতিশীল ছিলাম। এখনো আছি। উপন্যাসটি আরম্ভ করার আগে কেবল দুদিন এদের কথা মনে মনে ভেবেছিলাম।....... কিন্তু নকশাল আন্দোলন চোখের সামনে ঘটতে দেখেছি। রাজনৈতিক তত্ত্ব আমি কোনোদিনই বুঝিনি। আমি রাজনীতি সত্যি বুঝি না, এ সমস্ত দেখেছি একজন মানুষ হিসেবে। এক অরাজনৈতিক মা'র সেই তরুণ প্রজন্মকে বুঝবার চেষ্টা হল 'হাজার চুরাশির মা' উপন্যাস লেখাটি শারদীয় 'প্রসাদ' পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। শুনেছি, সে বছর পূজা সংখ্যাটি সব জেলের ভিতরে চলে। গিয়েছিল।”
(d) ‘অরণ্যের অধিকার’ :
- ১৯৭৯-তে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে ভূষিত হয় মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’ উপন্যাসটি ।
- অরণ্যের অধিকারকে কেন্দ্র করে ১৮৯৯ থেকে ১৯০০ সালে সংঘটিত মুন্ডাদের বিদ্রোহ ‘উলঘুলান’ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা । এই ঐতিহাসিক সত্যের নিরিখে ‘অরণ্যের অধিকার’ রচিত হয় ।
- ১৯৭৫ সালে ধারাবাহিক ভাবে 'বেতার জগৎ' পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
- পরে তা পরিমার্জনা সহ ১৯৭৭-এ গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ।
- উপন্যাসটি হিন্দি, গুজরাটি, মারাঠি, রাজস্থানি, ওড়িয়া, অসমিয়া প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয়।
- হিন্দি ও বাংলা সংস্করণ বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্য হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
পুরস্কার - সম্মাননা :
মহাশ্বেতাদেবী সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার ও র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারসহ একাধিক সাহিত্য পুরস্কার এবং ভারতের চতুর্থ ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান যথাক্রমে পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ পেয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে রাজ্যের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান বঙ্গবিভূষণে ভূষিত করেছিল।
মহাশ্বেতা দেবীর বিশেষত্ব :
মহাশ্বেতা দেবীর বিশেষত্ব এই যে, বাংলা উপন্যাসে দলিত শ্রেণির মানুষজনের সর্বাধিক উপস্থিতি ঘটিয়েছেন। তিনি বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক আদিবাসী জীবনকেন্দ্রিক উপন্যাস রচনা করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। তার সাহিত্যকর্ম ইংরেজি, জার্মান, জাপানি, ফরাসি এবং ইতালীয় ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। এছাড়া, অনেকগুলো বই ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। যেমন – হিন্দি, অসমীয়া, তেলেগু, গুজরাটি, মারাঠি, মালয়ালম, পাঞ্জাবি, ওড়িয়া এবং আদিবাসী হো ভাষা।

No comments