Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

ঔপন্যাসিক ও ছোটোগল্পকার ‘বনফুল’ (বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়) :

বাংলা সাহিত্য পাঠকের চোখে ‘বনফুল’ আজও এক বিস্ময় আর অনপনেয় রহস্য। তাঁর সৃষ্টিতে বিস্ময়ের দিকটি সার্থক ব্যাখ্যাত হয়েছে ড. শ্রীকুমার বন্দ্য...



বাংলা সাহিত্য পাঠকের চোখে ‘বনফুল’ আজও এক বিস্ময় আর অনপনেয় রহস্য। তাঁর সৃষ্টিতে বিস্ময়ের দিকটি সার্থক ব্যাখ্যাত হয়েছে ড. শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিচারদৃষ্টিতে—“বনফুলের রচনায় পরিকল্পনার মৌলিকতা, আখ্যানবস্তু সমাবেশে বিচিত্র উদ্ভাবনী শক্তি, তীক্ষ্ণ মননশীলতা ও নানারূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে মানব চরিত্রের যাচাই পাঠকের বিস্ময় উৎপাদন করে।” 
        সে বিস্ময়ের ঘোর আজও কাটেনি—বস্তুত বনফুলের রচনায় মুগ্ধতার উপকরণ যতটুকু, সে ঐ অনির্মোচনীয় বিস্ময় চমকে গড়া। বিধাতার সৃষ্টির মতোই তাঁর সৃষ্টি বিচিত্র ও বর্ণবহুল।

পরিচিতিঃ
        বলাইচাঁঁদ মুখোপাধ্যায় ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৯ শে জুলাই বিহারের পূর্ণিয়া জেলার মনিহারী গ্রামে (বর্তমানে কাটিহার জেলায়) জন্মগ্রহন করেন । কবির আদি নিবাস হুগলি জেলার শিয়াখালা গ্রাম। পিতা - সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়, মাতা - মৃণালিনী দেবী। কবির পেশা ছিল ডাক্তারি। লেখক পেশায় চিকিৎসক হলেও সাহিত্য চর্চা ছিল তাঁর নেশা। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ই ফেব্রুয়ারী কবি মারা যান ।

ছদ্মনামঃ ➡ বনফুল ( ছাত্রাবস্থায় ‘মালঞ্চ’ পত্রিকায় কবিতা প্রকাশের ঘটনাকে কেন্দ্র করেই তিনি ‘বনফুল’ ছদ্মনাম গ্রহণ করেন)।

প্রথম রচনাঃ
(a) সপ্তম শ্রেণীতে পড়ার সময় নিজ সম্পাদনায় বনফুল হাতে লেখা ‘বিকাশ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।
(b) মাসিক ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তাঁর প্রথম গল্প “চোখ গেলে” রচনা করেন।
(c) “তৃণখণ্ড”(১৯৩৫) বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের প্রথম উপন্যাস।
(d) তাঁর প্রথম মুদ্রিত গল্পগ্রন্থ “বনফুলের গল্প” ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত।

রচনাবলীঃ
        লেখক হিসেবে বনফুল হাজারেরও বেশি কবিতা, ৫৮৬টি ছোট গল্প, ৬০টি উপন্যাস, ৫টি নাটক, জীবনী ছাড়াও অসংখ্য প্রবন্ধ রচনা করেছেন। তার রচনাবলীসমগ্র ২২ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে ।

শেষ রচনাঃ
(a) তাঁর শেষ লেখা কবিতা সরস্বতী বন্দনা - “সর্বশুক্লা তুমি রূপবতী”। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে ১ লা ফেব্রুয়ারি তিনি কবিতাটি রচনা করেন।
(b) তাঁর শেষ উপন্যাস - “হরিশচন্দ্র” (১৯৭৯)।

আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থঃ  “পশ্চ্যাৎপট”।


উপন্যাসসমূহ :
(১) ‘তৃণখণ্ড’ (১৯৩৫)
(২) ‘বৈতরণী তীরে’ (১৯৩৬)
(৩) ‘দ্বৈরথ’ (১৯৩৭)
(৪) ‘কিছুক্ষন’ (১৯৩৭)
(৫) ‘মৃগয়া’ (১ম খন্ড - ১৯৪১, ২য় খন্ড - ১৯৪২, ৩য় খন্ড - ১৯৪৫)
(৬) ‘নির্মোক’ (১৯৪০)
(৭) ‘রাত্রি’ (১৯৪১)
(৮) ‘সে ও আমি’ (১৯৪৩)
(৯) ‘জঙ্গম’ (১ম খন্ড - ১৯৪৩, ২য় খন্ড - ১৯৪৫)
(১০) ‘সপ্তর্ষি’ (১৯৪৫)
(১১) ‘অগ্নি’ (১৯৪৬)
(১২) ‘স্বপ্নসম্ভব’ (১৯৪৭)
(১৩) ‘মানদণ্ড’ (১৯৪৮)
(১৪) ‘ডানা’ (১ম খন্ড- ১৯৪৮,  ২য় খন্ড - ১৯৫৫)
(১৫) ‘স্থাবর’ (১৯৫১)
(১৬) ‘প্রচ্ছন্ন মহিমা’ (১৯৫৩)
(১৭) ‘ভূবনসোম’ (১৯৫৭)
(১৮) ‘জলতরঙ্গ’ (১৯৫৭)
(১৯) ‘অগ্নিশ্বর’ (১৯৫৯)
(২০) ‘ওরা সব পারে’ (১৯৬০)
(২১)‘হাটে বাজারে’ (১৯৬১)
(২২) ‘জনাসু’ (১৯৬২)
(২৩) ‘তীর্থের কাকা’ (১৯৬৫)
(২৪)‘সন্ধিপূজা’ (১৯৭২)
(২৪) ‘আশাবরী’ (১৯৭২)
(২৬) ‘সাত সমুদ্র তেরো নদী’ (১৯৭২)
(২৭) ‘লী’ (১৯৭৮)
(২৮) ‘হরিশ্চন্দ্র (১৯৭৯) ।

ছোটগল্প-সংকলন :
        বনফুলের ছোটোগল্প সংকলনের সংখ্যা ৮টি । এগুলি হল :
(১) ‘অনুগামিনী’ (১৯৪৭)
(২) ‘ঊর্মিমালা’ (১৯৫৫)
(৩) ‘দূরবীন’ (১৯৬১)
(৪.)‘মনিহারা’
(৫) ‘সপ্তমী ’
(৬) ‘এক ঝাঁক খঞ্জন’ ।

কাব্যগ্রন্থ:
(১) বনফুলের কবিতা (১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দ),
(২) অঙ্গারপণী (১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ),
(৩) চতুর্দশী (১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দ),
(৪) আহ্বনীয় (১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দ),
(৫) করকমলেষু (১৯৪৯ খ্রিষ্টাব্দ),
(৬) বনফুলের ব্যঙ্গ কবিতা (১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ),
(৭) নতুন বাঁকে (১৯৫৯ খ্রিষ্টাব্দ)।

ছোটগল্পসমূহ :
       ‘দুধের দাম’ ‘সুলেখার ক্রন্দন’, ‘অজান্তে ’, ‘এক ফোঁটা জল’, ‘ছোটলোক’, ‘মানুষ’, ‘পরিবর্তন’, ‘মালাবদল’, ‘নিমগাছ’, ‘জ্যোৎস্না’, ‘তপন’, ‘ব্যতিক্রম’ ।

নাটক :
(১) ‘শ্রীমধুসূদন’(১৯৩৯),
(২) ‘বিদ্যাসাগর’ (১৯৪১),
(৩) ‘রূপান্তর ’ (১৯৩৭)
(৪) ‘মন্ত্রমুগ্ধ ‘১৯৩৮)।

প্রবন্ধ:
(১) ‘শিক্ষার ভিত্তি’ (১৯৫৫)- সমকালীন শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে লেখা। 
(২)‘ দ্বিজেন্দ্রদর্পন’(১৯৬৭) - দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সম্পর্কে স্মারক বক্তৃতা।
(৩)‘ ভূয়োদর্শন’(১৯৪২) -কমলাকান্তের ভঙ্গিতে লেখা।

ডায়রি জাতীয় রচনা:
(১) ‘রবীন্দ্র স্মৃতি’ (১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দ),
(২) ‘মর্জিমহল’(১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ)।


আলোচনাঃ
⇛ ‘তৃণখন্ড’ উপন্যাসে ডাক্তারের চোখে সংসারের বিচিত্র মানব জীবনের ছবি চিত্রিত ।
⇛ ‘দ্বিতীয় উপন্যাস ‘বৈতরণীর তীরে’ ডাক্তারি অভিজ্ঞতার আর এক ভয়াবহ দিক উদঘাটিত । এর মূল চরিত্র ডাক্তার । 
⇛ ‘সে ও আমি’ উপন্যাসে ‘সে’ কেন্দ্রীয অন্তর্শায়ী রূপ, ‘আমি’ হল দ্বিতীয় সত্তা ।
⇛ ‘কিছুক্ষন’ উপন্যাসের ঘটনা অনেকটা ‘ক্যান্টাবেরি টেলস্’ এর মত ।
⇛  ‘অগ্নিশ্বর’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র লেখকের অধ্যাপক ব্যঙ্গ শিল্পী ডাক্তার বনবিহারী মুখোপাধ্যায়ের চরিত্রের আদর্শে চিত্রিত।
⇛ ‘উদয় অস্ত’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র মরনোন্মুখ ডাক্তার  সূর্যসুন্দর লেখকের পিতা মনিহারীর জনপ্রিয় ডাক্তার সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়ের আদলে গঠিত। 
⇛ ইতিহাস ভিত্তিক উপন্যাস -- ‘মহারানী’ ও ‘সন্ধিপূজা’ । ‘মহারানী’ - সিপাহী বিদ্রোহের পটভূমিতে লেখা আর ‘সন্ধিপূজা’ - পলাশী যুদ্ধের পটভূমিতে েলেখা ।
  দেশ বিভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা নিয়ে লেখা দুটি উপন্যাস -- ‘পঞ্চবর্ণ’ও  ‘ত্রিবর্ণ’ ।
⇛ ‘অগ্নি’-  উপন্যাসটি আগষ্ট আন্দোলনের পটভূমিতে গড়ে উঠেছে।
⇛ বনফুলের তিনটি শ্রেষ্ঠ উপন্যাস -- ‘স্থাবর’, ‘জঙ্গম’ ও ‘ডানা’।
⇛ তিনখন্ডে বিভক্ত ‘ডানা’ উপন্যাসটিকে বনফুলের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলে মনে করা হয় । 
⇛ ‘ডানা’র প্রধান চরিত্র চারটি - পক্ষীতত্ত্ববিদ অমরেশ, জড়বাদী রূপচাঁদ, বর্মার উদবাস্তু যুবতী নির্বান্ধব ডানা ও কবি আনন্দমোহন।
⇛ বাংলা সাহিত্যে সর্বপ্রথম অণুগল্প লেখেন বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়।
⇛ পোস্টকার্ড স্টোরির জনক। 
⇛ এধরনের গল্পকে কেউ বলেছেন 'Five Minutes'। 
⇛ বুদ্ধদেব বসু এ ধরণের গল্পকে বলেছেন 'এক চুমুক'।

অন্যান্য তথ্যাবলীঃ
 ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় ‘শরৎস্মৃতি’ পুরস্কার লাভ করেন
⇛ “হাটে বাজারে” উপন্যাসের জন্য তিনি ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ‘রবীন্দ্র’ পুরস্কার লাভ করেন।
⇛ ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়কে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘সন্মানিক ডি.লিট’ প্রদান করা হয়।
⇛  বনফুল নিজের ব্যাখ্যায় বলেছিলেন - “ছেলেবেলায় ভৃত্য মহলে আমার নাম ছিল ‘জংলি বাবু”।
⇛ বনফুল তাঁর ‘গল্প’ নামক গল্পে বলেছেন - “ছোটগল্পকে ছোট হতে হবে এবং একটি মুহূর্তের ঘটনা তার কাহিনী বৃত্তে আবর্তিত হবে”।
⇛ লেখক সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন - “যেন তুমি উদ্ভিদ বিজ্ঞানী”।
⇛ তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাসায় বেড়াতে এলে বনফুল তাঁকে তাঁর “টাইফয়েড” গল্পটি পড়ে শোনান এবং তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় মুগ্ধ হন।

বনফুলের গল্পের অভিনবত্বঃ
        রবীন্দ্রনাথ বনফুলের ছোটগল্পের প্রশংসা করে বনফুলকে যে চিঠি লিখেছিলেন তাতে বনফুলের গল্পের অভিনবত্বের তিনটি উপকরণ চোখে পড়ে—
(১) বনফুলের রচনায় বিষয়বস্তুর সঞ্চয় ভাণ্ডার ‘চোখ এড়ানো সামগ্রী নিয়ে’ গড়া। বলাবাহুল্য তা দৈনন্দিন জীবনের তুচ্ছতা থেকে আহৃত। 
(২) তাঁর গঠনশৈলীতে আত্মসংবরণের বিজ্ঞানী জনোচিত সন্তর্পণ প্রয়াস। কারণ তিনি ছিলেন মিতবাক্ শিল্পী। 
(৩) তাঁর বিজ্ঞানী মেজাজে গড়া গল্পগুলি চোখ ভোলায় না, কৌতূহলের কৌতুকে হাততালির উৎসাহকে উৎসারিত করে তোলে।

No comments