নবম শ্রেণীর ‘সাহিত্য সম্ভার’ বইয়ের প্রতিটি বিষয় আমাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । আজকের আলোচনা ‘বীরবাহুর মৃত্যুতে রাবণ’ ।
নবম শ্রেণীর ‘সাহিত্য সম্ভার’ বইয়ের প্রতিটি বিষয় আমাদের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে । আজকের আলোচনা ‘বীরবাহুর মৃত্যুতে রাবণ’ ।
‘বীরবাহুর মৃত্যুতে রাবণ’
-------- মাইকেল মধুসূদন দত্তমূল কবিতা ঃ
মহাশোকে শোকাকুল কহিলা রাবণ---
“যে শয্যায় আজি তুমি শুয়েছ, কুমার
প্রিয়তম, বীরকুলসাধ এ শয়নে
সদা ! রিপুদলবলে দলিয়া সমরে,
জন্মভূমি রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?
যে ডরে, ভীরু সে মুঢ়; শত ধিক্ তারে!
তবু, বস, যে হৃদয়, মুগ্ধ মোহমদে
কোমল সে ফুল-সম। এ বজ্র আঘাতে,
কত যে কাতর সে, তা জানেন সে জন,
অন্তর্যামী যিনি; আমি কহিতে অক্ষম।
হে বিধি, এ ভবভূমি তব লীলাস্থলী: -
পরের যাতনা কিন্তু দেখি কি হে তুমি
হও সুখী? পিতা সদা পুত্ৰদুঃখে দুঃখী --
তুমি হে জগৎ-পিতা, এ কি রীতি তব?
হা পুত্র! হা বীরবাহু বীরেন্দ্র-কেশরী!
কেমনে ধরিব প্রাণ তোমার বিহনে?”
এইরুপে আক্ষেপিয়া রাক্ষস-ঈশ্বর
রাবণ, ফিরায়ে আঁখি, দেখিলেন দূরে
সাগর-মকরালয়। মেঘশ্রেণি যেন
অচল, ভাসিছে জলে শিলাকুল, বাঁধা
দৃঢ় বাঁধে। দুই পাশে তরঙ্গ-নিচয়,
ফেণাময়, ফণাময় যথা ফণিবর,
উথলিছে নিরন্তর গম্ভীর নির্ঘোষে।
অপূর্ব-বন্ধন সেতু, রাজপথ-সম
প্রশস্ত বহিছে জলস্রোতঃ কলরবে,
স্রোতঃ-পথে জল যথা বরিষার কালে।
অভিমানে মহামানী বীরকুলষর্ভ
রাবণ, কহিলা বলী সিন্ধু পানে চাহি;—
“কী সুন্দর মালা আজি পরিয়াছ গলে,
প্রচেতঃ! হা ধিক্, ওহে জলদলপতি!
এই কি সাজে তোমারে, অলঙ্ঘ্য, অজেয়
তুমি? হায়, এই কি হে তোমার ভূষণ,
রত্নাকর? কোন্ গুণে, কহ দেব, শুনি,
কোন গুণে দাশরথি কিনেছে তোমারে?
প্রভঞ্জন বৈরী তুমি; প্রভঞ্জন-সম
ভীম পরাক্রমে। কহ, এ নিগড় তবে
পর তুমি কোন্ পাপে? অধম ভালুকে
শৃঙ্খলিয়া জাদুকর, খেলে তারে লয়ে;
কেশরীর রাজপদ কার সাধ্য বাঁধে
বীতংসে? এই যে লঙ্কা, হৈমবতী পুরী,
শোভে তব বক্ষঃস্থলে, হে নীলাম্বুস্বামি,
কৌস্তুভ রতন যথা মাধবের বুকে,
কেন হে নির্দয় এবে তুমি এর প্রতি?
উঠ, বলি; বীরবলে এ জাঙাল ভাঙি,
দূর কর অপবাদ; জুড়াও এ জ্বালা,
ডুবায়ে অতল জলে এ প্রবল রিপু।
রেখো না গো তব ভালে এ কলঙ্ক-রেখা,
হে বারীন্দ্র, তব পদে এ মম মিনতি।"
উৎস
মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত বাংলা সাহিত্যের কালজয়ী প্রকাশ 'মেঘনাদবধ কাব্যের প্রথম সর্গের অন্তর্ভুক্ত পাঠ্যাংশে গৃহীত ‘বীরবাহুর মৃত্যুতে রাবণ’ শীর্ষক অংশটি।
বিষয়বস্তু :
পিতা রাবণ ও জননী চিত্রাঙ্গদার একমাত্র সন্তান বীরবাহু যুদ্ধক্ষেত্রে রামের বাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করেছে। সন্তানহারা রাজা রাবণের পিতৃসত্তার ব্যাকুল হাহাকার প্রকাশিত হয়েছে। রাজা রাবণ বিশ্বাস করেন বীরকুলের প্রতিটি বীরের পরম আকাঙ্ক্ষিত বিষয় হল বীরের মতো যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুবরণ করা, কিন্তু পিতা রাবণ এতে সায় দিতে পারেন না। আর তাইতো তিনি বিধাতাকে দোষারোপ করেন—'পরের যাতনা.…... দেখি কি হে তুমি হও সুখী?’ সমুদ্রের বুকে সেতুবন্ধন দেখে অভিমানাহত রাবণ সমুদ্রকে সম্বোধন করে ব্যঙ্গবাণে দীর্ণ-বিদীর্ণ করে তাকে বলেন যে দারুণ সুন্দর মালা সে তার গলায় ধারণ করেছে। অলঙ্ঘ্য, অজেয় সমুদ্র অবশেষে শৃঙ্খলে আবদ্ধ হল! রাবণের একান্ত ইচ্ছা যে সমুদ্র তার সর্বশক্তি প্রয়োগ করে রাম-নির্মিত এই সেতু নিমেষে চূর্ণবিচূর্ণ করে তার পুত্রহত্যার প্রতিশোধ নেয় এবং আপন বীরত্ব বিক্রম প্রকাশ করে। তাইতো সমুদ্রকে উজ্জীবিত করতে রাজা রাবণ তাকে জানান যে ভালুকের মতো অতি সাধারণ ও নগণ্য প্রাণীকে নিয়ে জাদুকর খেলা দেখাতেই পারে, কিন্তু বীরত্বের অধিকারী সিংহকে শৃঙ্খলিত করা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব হয় না। মাধবের বক্ষদেশে অবস্থিত কৌস্তুভ রতনের ন্যায় এই স্বর্ণলঙ্কা সমুদ্রের বক্ষঃস্থলে জাজ্বল্যমান। রাজা রাবণের একান্ত মিনতি সমুদ্র যেন তার বক্ষদেশের সেতুবন্ধন চূর্ণবিচূর্ণ করে রাবণের তাপিত বক্ষঃস্থল শীতল করেন।
লেখক পরিচিতি :
মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩): জন্ম অধুনা বাংলাদেশের যশোহর জেলার সাগরদাঁড়ি গ্রামে। বাল্যবয়সেই কলকাতায় এসে হিন্দু কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তাঁর সহপাঠী ছিলেন ভূদেব মুখোপাধ্যায়, রাজনারায়ণ বসু, গৌরদাস বসাক প্রমুখ। গ্রিক, ল্যাটিন, সংস্কৃত ও ইংরেজি ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। প্রথম জীবনে ইংরেজি ভাষায় দুটি গ্রন্থ রচনা করলেও পরবর্তী পর্যায়ে কবি মধুসূদন ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, ‘তিলোত্তমাসম্ভব কাব্য’, ‘বীরাঙ্গনা কাব্য’, ‘ব্রজাঙ্গনা কাব্য’, ‘চতুর্দশপদী কবিতা’রচনার মধ্যে দিয়ে বাংলা কাব্য-কবিতার ইতিহাসে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। ‘রত্নাবলী’, ‘শর্মিষ্ঠা’, ‘পদ্মাবতী’, ‘কৃষ্বকুমারী’ প্রভৃতি নাটক এবং ‘একেই কি বলে সভ্যতা’ ও ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নামক দুটি প্রহসন তাঁর অনবদ্য সৃষ্টি।‘পদ্মাবতী’ নাটকে তিনি প্রথম অমিত্রাক্ষর ছন্দ ব্যবহার করেন।
খুব শীঘ্রই প্রশ্নোত্তর সংযোজন করা হবে

No comments