উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তখন মুসলিম রাজত্বের সমাপ্তি ঘটেছে, ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা ঘটতে শুরু হয়েছ...
উনিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তখন মুসলিম রাজত্বের সমাপ্তি ঘটেছে, ইংরেজ রাজত্বের প্রতিষ্ঠা ঘটতে শুরু হয়েছে। মুসলমানরা ভারতের ধর্মকে আঘাত করলেও ভারতের সমাজও শিক্ষা-দীক্ষায় আঘাত করেনি, কিন্তু ইংরেজরা প্রথম পঞ্চাশ বছর রাজত্বকালে ভারতের শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে আঘাত হানে। তখন নাট্যশিক্ষিত বাঙালিরা বাংলা কথা বলতে, বাংলা অক্ষরে নাম লিখতে, বাংলার বই পড়তে লজ্জাবোধ করত। এমন এক অবস্থায় বাংলা সাহিত্য ক্ষেত্রে আবির্ভূত হন বঙ্কিমচন্দ্র ।
পরিচয় ঃ
বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দের ২৬ জুন (১২৪৫ বঙ্গাব্দের ১৩ আষাঢ়) চব্বিশ পরগণা জেলায় নৈহাটির কাছে কাঁঠাল পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পূর্বপুরুষেরা ছিলেন হুগলি জেলার দশমুখো গ্রামের অধিবাসী। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রপিতামহ রামহরি চট্টোপাধ্যায় মাতামহের সম্পত্তি লাভ করে কাঁঠালপাড়ার বসতি স্থাপন করেন। বঙ্কিমচন্দ্রের পিতা - যাদব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। কর্মজীবনে সুদস্ক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। এবং এর জন্য তিনি রায়বাহাদুর উপাধি পেযেছিলেন। ১৮৭২খ্রিস্টাব্দে 'বঙ্গদর্শন' পত্রিকা সম্পাদনার মধ্যদিযে বঙ্কিমচন্দ্রের (১৮৩৮-১৮৯৪) প্রবন্ধ সাহিত্যে প্রবেশ ঘটে। বঙ্গদর্শন ছাড়াও তিনি প্রচার', 'নবজীবন','সাধারনী' প্রভৃতি পত্রিকায় প্রবন্ধ লিখেছেন।
প্রবন্ধ গ্রন্থ ঃ
‘বঙ্গদর্শন’ প্রকাশের পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্র বাংলা প্রবন্ধ সম্পর্কে বিশেষ কৌতূহলী ছিলেন না । অবশ্য এই সময় তিনি `Review' পত্রিকায় 'Bengali literature' (1871) নামে একখানি প্রবন্ধে মধ্যযুগীয় ও আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছিলেন । তাঁর অধিকাংশ প্রবন্ধই ‘প্রচার’, ‘নবজীবন’, ‘সাধারণী’, ‘বঙ্গদর্শন’ - ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ।
প্রাবন্ধিক বঙ্কিমচন্দ্র -এর প্রবন্ধ গুলিকে মোটামুটি চার শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায় । যথা ---
দর্শন ও ইতিহাস ধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ ঃ
(a) বিবিধ সমালোচনা (1876)
(b) সাম্য (1879)
(c) প্রবন্ধ পুস্তক (1879)
(d) কৃষ্ণ চরিত্র (1886)
(e) বিবিধ প্রবন্ধ (১ম খন্ড 1888, ২য় খন্ড-1892)
(f) ধর্মতত্ব (1888)
(g) শ্রীমতভাগবত (1902)
বিজ্ঞান ধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ ঃ
(a) ‘বিজ্ঞান রহস্য’-(1875)।
সাহিত্য সমালোচনা ধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ ঃ
(a) 'Bengali literature' (1871),
(b) ‘ প্রবন্ধ পুস্তক’ (1878)
ব্যক্তি ধর্মী প্রবন্ধগ্রন্থ ঃ
(a) ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ (1875)
(b) ‘লোকরহস্য (1874)
(c) ‘ মুচিরাম গুড়ের জীবন চরিত’ (1884)
প্রবন্ধগ্রন্থ পরিচয় ঃ
(b) ‘লোকরহস্য (1874) ঃ
---- ‘লোকরহস্য'র প্রবন্ধগুলি সমাজব্যঙ্গমূলক। এগুলিতে বিষয়বস্তু অপ্রধান না হলেও রচনা রসসম্ভোগও সমান গুরুত্বপূর্ণ। চিন্তাকে এখানে ব্যঙ্গ ও কৌতুকরসে রূপান্তরিত করা হয়েছে। এগুলির রঙ্গরস মাঝে মাঝে বেশ তীব্র হয়ে উঠেছে। অসঙ্গত কল্পনা, উদ্ভট পরিস্থিতি, রঙ্গাত্মক অতিরঞ্জন এইসব রচনায় হাস্যরসের কারণ হয়ে উঠেছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশক থেকে যে ব্যঙ্গাত্মক নকশার প্রচলন হয়েছিল বঙ্কিমচন্দ্রের এ রচনায় তা উৎকর্ষের চরমে উঠেছে।
(b) ‘বিজ্ঞান রহস্য’-(1875) ঃ
---- ‘বিজ্ঞান রহস্য’ মূলত পাশ্চাত্য হাক্সলীর বিজ্ঞান ভিত্তিক রচনাকে অনুসরণ করে লেখা । এই প্রবন্ধ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত প্রবন্ধ গুলি হলো- 'আশ্চর্য সৌরপাত', 'আকাশে কত তারা আছে', 'ধুলাগগন', 'পর্যটন', 'চঞ্চল জগৎ', 'কতকাল মনুষ্য', জৈবনিক', 'পরিমান রহস্য', 'চন্দ্রলোক' প্রভৃতি।
(c) ‘কমলাকান্তের দপ্তর’ (1875) ঃ
--- ইংরেজ সাহিত্যিক ও সমালোচক ডি-কুইন্সের 'Confessions of an English Opium Eater'-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। মূলত ডি-কুইন্সের রচনার দ্বারা প্রভাবিত হলেও ‘কমলাকান্তের দপ্তর' রচনার ক্ষেত্রে লিহান্ট ও স্কটের প্রভাব রয়েছে। প্রথম প্রকাশের সময় মোট ১১ টি প্রবন্ধ ছিল এর ভিতরে।
(কমলাকান্তের দপ্তর— ১৪টি নিবন্ধ বর্তমান। কমলাকান্তের পত্র -৫টি নিবন্ধ বর্তমান। কমলাকান্তের জবানবন্দী ১টি নিবন্ধ। পরের সংস্করণে কমলাকান্তের পত্রগুলি যুক্ত হয় এবং ‘কমলাকান্ত' নামে প্রচারিত হয়। এই প্রবন্ধ গ্রন্থটি তিনি ‘কমলাকান্ত’ ছদ্মনামে লেখেন ।)
** এই প্রবন্ধ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলি হল ঃ ‘একা কে গায় ওই’, ‘মনুষ্য ফল’, ‘ইউটিলিটি বা উদার দর্শন’, ‘পতঙ্গ, ‘আমার মন’, ‘চন্দ্রালোকে’, ‘বসন্তের কোকিল’, ‘স্ত্রীলোকের রুপ’, ‘ফুলের বিবাহ’, ‘বড়োবাজার’, ‘আমার দুর্গোৎসব’, ‘একটি গীত’ ‘বিড়াল’, ‘মশক’ ।
( ‘চন্দ্রালোকে’, ‘মশক’, ‘স্ত্রীলোকের রুপ’ --- এই তিনটি প্রবন্ধ বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা নয় । ‘চন্দ্রালোকে’, ‘মশক’ --- লিখেছেন -অক্ষয়চন্দ্র সরকার এবং ‘স্ত্রীলোকের রূপ’ লিখেছেন - রামকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় ।)
** বিখ্যাত চরিত্র ঃ কমলাকান্ত, ভীষ্মদেব খোসনবীশ, নসীরামবাবু, প্রসন্ন গোয়ালিনী ।
(d) ‘ মুচিরাম গুড়ের জীবন চরিত’ (1884) ঃ
- দীনবন্ধু মিত্রের ‘সধবার একাদশী’র ঘটিরাম ডেপুটির দ্বারা অনুপ্রানীত হয়ে ‘দর্পনারায়ণ পুতিতুন্ড’ ছদ্মনামে লেখা।
(e) ‘বিবধ প্রবন্ধ’ (1888 - 92) ঃ
--- ‘বিবিধ প্রবন্ধে'র অন্তর্গত ‘উত্তরচরিত’, ‘গীতিকাব্য’, ‘বিদ্যাপতি' ও জয়দেব', 'প্রকৃত এবং অতিপ্রকৃত,‘দ্রৌপদী’, ‘শকুম্ভলা মিরন্দা এবং দেসদিমোনা', 'ধর্ম ও সাহিত্য’, ‘বাঙ্গালার নব্য লেখকদিগের প্রতি নিবেদন', 'বঙ্গদর্শনের পত্র সূচনা' 'বাঙ্গলাভাষা' প্রভৃতি প্রবন্ধে বঙ্কিমের সাহিত্য চিন্তার পরিচয় মেলে।
(f) কৃষ্ণ চরিত্র (1886) ঃ
-- ‘কৃষ্ণচরিত্র’ একাধারে ধর্মতত্ত্ব ও প্র-তত্ত্ব। বঙ্কিমচন্দ্র কৃষ্ণচরিত্রে প্রথমত, মহাভারতের ঐতিহাসিকতা প্রতিপন্ন করেছেন—তিনি নিপুণভাবে দেখিয়েছেন, মহাভারত কল্পনামূলক কাব্য নয়, প্রামাণিক ইতিহাস (History)। বঙ্কিম বীরদর্প সহকারে কৃষ্ণচরিত্র গ্রন্থে স্বাধীন মনুষ্যবুদ্ধির জয়পতাকা উড্ডীন করেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধচর্চার গুরুত্ব ঃ
নানা প্রবন্ধের সাহায্যে বঙ্কিমচন্দ্র বাঙালিকে প্রবুদ্ধ করতে চেয়েছিলেন। তদানীস্তন বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজের প্রধান নিয়ামক শক্তি বলে তাঁকে অভিহিত করা যায়। রবীন্দ্রনাথ ব্যতীত আর কোনো ব্যক্তিত্ব বঙ্কিমচন্দ্রের মতো বাঙালির জীবনে গভীরভাবে নিজ মন ও মনন এবং ব্যক্তিত্বের ছাপ মুদ্রিত করে দিতে পারেননি। সর্বোপরি তিনি নিজে শুধু প্রবন্ধ রচনা করে বাঙালির চিত্তবিকাশে সাহায্য করেননি, তাঁর চারিদিকে একদল বুদ্ধিমান শিষ্য তৈরি করে তাঁদের সাহায্যেও বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের সবিশেষ উন্নতি করেছিলেন।
বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের অবদান ঃ
বঙ্কিমচন্দ্রের আবির্ভাবে প্রবন্ধ সাহিত্যে চিন্তাপ্রধান এবং রসপ্রধান উভয় ধারার বিশেষ উন্নতি ঘটে।। বঙ্কিমের সৌন্দর্যপ্রধান প্রবন্ধ লোকরহস্য ব্যঙ্গরসে এবং কমলাকান্ত কখনও রোমান্টিক উপলব্ধিতে সার্থক। সমালোচক বঙ্কিমচন্দ্র সংস্কৃতানুগ ধারাটি অস্বীকার করে ইংরেজি রোমান্টিক সমালোচনার ধারাটি নিয়ে এলেন। ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক প্রবন্ধে তিনি উদারমুক্ত মনোভাব এবং বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টি তথা গভীর স্বদেশপ্রেমের পরিচয় দিয়েছেন। অর্থনৈতিক প্রবন্ধে সাম্যবাদের পক্ষে মত আর নিষ্কাম কর্মের আদর্শ প্রচার তাঁর শেষেরদিকের প্রবন্ধের লক্ষ্য।
‘কমলাকান্তের দপ্তর' গ্রন্থখানির সংক্ষিপ্ত বৈশিষ্ট্য ঃ
ভাষার মাধুর্যে, ভাবের মনোহারিত্বে, শুভ্র সংযত সরস রসিকতায়, অকৃত্রিম স্বদেশেপ্রেমে গ্রন্থটি বঙ্গসাহিত্যের গৌরব। হাসির সঙ্গে করুণের, অদ্ভুতের সঙ্গে সত্যের, তরলতার সঙ্গে মর্মদাহিনী জ্বালার, নেশার সঙ্গে তত্ত্ববোধের, ভাবুকতার সঙ্গে বস্তুতন্ত্রতার, শ্লেষের সাথে উদারতার এমন মনোমোহন সমন্বয় বিরল।
‘কমলাকান্তের দপ্তর’ গ্রন্থের মৌলিকতা ঃ
‘কমলাকান্তের দপ্তর’ বঙ্কিমের একটি উচ্চস্তরের প্রবন্ধ গ্রন্থ। এর মধ্যে যারা ডি-কুইন্সের রচনার সাদৃশ্য খোঁজেন তাঁরা বহিরঙ্গকেই অধিক গুরুত্ব দেন। রচনাটির মৌলিকতায় সন্দেহ করা চলে না। কমলাকান্তের মাধ্যমে বঙ্কিমচন্দ্রের নির্জন ব্যক্তিসত্তার আর্তি ধ্বনিত। গদ্য ভাষাকে নমনীয় করে কতটা গীতিঝংকারের সৃষ্টি করা যায় বঙ্কিমচন্দ্র কমলাকান্তের দপ্তরে তা দেখিয়েছেন।

No comments