Page Nav

HIDE

Classic Header

{fbt_classic_header}

NEW :

latest

‘জাগরী’র রচয়িতা সতীনাথ ভাদুড়ী :

সময়টা ১৯৪২। গোটা ভারতবর্ষ তখন গাঁধীজির ভারত ছাড়ো আন্দোলনের জ্বরে কাঁপছে। ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলের ঠান্ডা মেঝেতে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কী যেন লি...



সময়টা ১৯৪২। গোটা ভারতবর্ষ তখন গাঁধীজির ভারত ছাড়ো আন্দোলনের জ্বরে কাঁপছে। ভাগলপুর সেন্ট্রাল জেলের ঠান্ডা মেঝেতে বসে ঘাড় গুঁজে একমনে কী যেন লিখে চলেছেন এক বন্দি। যে সে বন্দি নন, রাজবন্দি। জেলের ভেতরেও তিনি কড়া নজরদারিতে থাকেন। আগে একবার দলবল নিয়ে জেল ভেঙে পালাবার চেষ্টা করেছিলেন। পারেননি। সেই স্মৃতি ঘাড়ের পাশে পুলিশের রুলের মোটা দাগ নিয়ে জেগে। জেলে বসেই সেই লেখা পড়ে ফেললেন তাঁর এক অনুগত শিষ্য, তিনিও রাজবন্দি। ‘ময়লা আঁচল’-এর লেখক ফণীশ্বরনাথ ‘রেণু’। পড়ে শুধু মুগ্ধই হলেন না, কেঁদে ফেললেন। ‘ভাদুড়ীজি’র পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বললেন, ‘‘আমি ধন্য হলাম এই অসামান্য উপন্যাসের প্রথম পাঠক হতে পেরে।’’ এই ঔপন্যাসিক আর কেউ নন, তিনি সতীনাথ ভাদুড়ী ।

ব্যক্তি জীবন :
সতীনাথ বিহারের পূর্ণিয়ায় ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৭ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর লেখাপড়া ও কর্মজীবন কাটে পূর্ণিয়াতেই। ওকালতি ছিল তাঁর পেশা। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন এবং রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে জেল খেটেছিলেন। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক হলেন সতীনাথ। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মার্চ তিনি মারা যান।
প্রথম রচনা :
  • ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে সতীনাথের প্রথম গল্প ‘জামাইবাবু’ প্রকাশিত হয় 'বিচিত্রা' পত্রিকায়।
  • প্রথম উপন্যাস ‘জাগরী’ ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় । 
  • প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘গণনায়ক’ ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত হয় । 
শেষ রচনা :
  • শেষ উপন্যাস ‘দিগভ্রান্ত’ । উপন্যাসটি লেখকের মৃত্যুর পর ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়।  
উপন্যাসসমূহ :
শিল্প-সচেতন ঔপন্যাসিক হিসাবে সতীনাথ ভাদুড়ী স্মরণীয় হয়ে আছেন। ১৯৪৫-১৯৬৫ পর্যন্ত সমাজ জীবনের পটভূমি সতীনাথের উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হল ---
  • ‘জাগরী’ (১৯৪৫),
  • 'ঢোঁড়াই চরিত মানস' (দুখণ্ড, ১৯৪৯-৫১),
  • 'অচিন রাগিনী' (১৯৫৪),
  • 'সংকট' (১৯৫৭),
  • 'চিত্র গুপ্তের ফাইল' (১৩৫৬, বঙ্গাব্দ)
  • 'দিগ্‌ভ্রান্ত' (১৯৬৬) ।
ভ্রমণ কাহিনী : ‘সত্যি ভ্রমণ কাহিনী’ (১৯৫১) ।
গল্পগ্রন্থ :
সতীনাথ ভাদুড়ী  যে দায়বদ্ধ লেখক, সে প্রমাণ তাঁর ছোটোগল্পেও মেলে । 'উপন্যাসের মতো ছোটোগল্পেও সতীনাথ সমাজ জীবনকে যথাযথভাবে উপস্থাপিত করেছেন। সতীনাথের গল্প-সংকলনগুলো হল :
  • ‘গণনায়ক' (১৯৪৮), 
  • 'অপরিচিতা' (১৯৫৪), 
  • 'চকাচকী' (১৯৫৬), 
  • 'পত্রলেখার বাবা' (১৯৫১), 
  • 'জলভ্রমি' (১৯৬২), 
  • 'আলোকদৃষ্টি' (১৯৬৪)
রচনা সংকলন সতীনাথ বিচিত্রা’ (১৯৬৫)   
নাটক : ‘পারবো না এদের সঙ্গে’ । 
             ( নাটকটি ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ন - পৌষ সংখ্যায় ‘পরিচয়’ পত্রিকািয় প্রকাশিত হয় ।  কিন্তু নাটকটি গ্রন্থাকারে
               প্রকাশিত হয় নি । এই নাটকটি তাঁর রচিত ‘মুনাফা ঠাকুরণ’ ব্যঙ্গগল্পের নাট্যরূপ )। 
আলোচনা :
(a) জাগরী :
  • ভাগলপুরে জেলে বসে সতীনাথ রাজনৈতিক উপন্যাস 'জাগরী' রচনা করেন।
  • ফাঁসীর দন্ডে অভিযুক্ত এক রাজবন্দি আসামীর সঙ্গে তার বাবা - মা এবং ছোটো ভাই নীলুর সারারাতের স্মৃতিচারণায় কাহিনী কথন । 
  • ‘শনিবারের চিঠি’ পত্রিকায় উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয । 
  • এটি তাঁর প্রকাশিত প্রথম উপন্যাস । 
  • এটি রাজনৈতিক উপন্যাস ।
  • এটি কারা উপন্যাস ।
  • উপন্যাসটি আত্মকথন রীতিতে রচিত । 
  • উপন্যাসটিতে ‘ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের’ লক্ষ্মন রয়েছে ।
  • আগস্ট আন্দোলনে পটভূমিকায় উপন্যাসটি রচিত হয়েছে।
  • ‘ময়লা আঁচল’ উপন্যাসের লেখক ফণীশ্বর নাথ রেণু এই উপন্যাসের প্রথম পাঠক ও শ্রোতা ।
  • উপন্যাসটি ১৯৫০ সালে প্রথম রবীন্দ্র পুরষ্কার পায় ।
  • প্রধান চরিত্র -- নীলু, বীলু ।
** অনুবাদ : 
  • `UNESCO থেকে লীলা রায় উপন্যাসটির ইংরাজি অনুবাদ `The Vigil' - ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশ করেন ।
  • নারায়ণ প্রসাদ ভার্মা ‘বিহার সাহিত্য ভবন’ থেকে ‘১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে হিন্দি অনুবাদ প্রকাশ করেন । 
  • সোহন সিং মিশা পাঞ্জাবী ভাষায় উপন্যাসটিকে অনুবাদ করেন । 
(b)‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’ :
  • এই উপন্যাসটি লেখকের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ।
  • এটি আঞ্চলিক উপন্যাস ।
  • এই উপন্যাসে আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক ভাবনার সবোর্ত্তম প্রকাশ লক্ষ্য করা যায় ।
  • সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় উপন্যাসটি সম্পর্কে জানিয়েছেন ঃ ‘‘ বইখানি document হিসাবে অপূর্ব তো বটেই, Psychological মূল্যও অসাধারণ ।"
  • উপন্যাসটি তুলসী দাসের ‘রামচরিতমানস’ গ্রন্থের অনুসরণে লেখা ।
  • বিহারের একটি শহর জিরানিয়ার নিকটবর্তী তাৎমাটুলির তাৎমা সম্প্রদায়ের মানুষদের নিয়ে এই উপন্যাসটি রচিত ।
  • চরিত্র ঃ বুধনী, ঢোঁড়াই, রামাইয়া ।
(c) ‘অচিন রাগিনী’ ঃ
  • ‘উপন্যাসটি ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের মাঘ মাস থেকে ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দের জ্যোষ্ঠ মাস পর্যন্ত ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । 
  • গ্রন্থাকারে প্রকাশিহ হয় ১৯৫৪ খ্রিষ্টাব্দে । 
  • `জাগরী’ উপন্যাসের মতো এই উপন্যাসে গল্প বলার ভঙ্গি পাঠককে মুগ্ধ করে । 
  • উপন্যাসটি মূলত - ‘পিলে, নতুন দিদিমা আর তুলসী তিনজনকে নিয়ে এই টান - ভালোবাসার গল্প’ ।
(d) ‘সংকট’ ঃ
  • এটি আধুনিক চেতনাপ্রবাহী উপন্যাস।
  • লেখক উপন্যাসের চরিত্রদের প্রতিই অধিক দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন। 
  • বিশ্বাসজীর চরিত্রকে যথাযথভাবে পরিস্ফুট করেছেন সতীনাথ ভাদুরী। 
(e)‘ চিত্রগুপ্তের ফাইল’ ঃ
  • উপন্যাসটি ১৯৪৮-এ এটি রচিত হয়। 
  • এটি সতীনাথের দ্বিতীয় উপন্যাস ।
  • ১৯৪৮ সালের ৩১শে জানুয়ারী অর্থাৎ মহাত্মা গান্ধীর তিরোধানের পরের দিন থেকে শুরু করে প্রায় ১৫ দিন ধরে চলে উপন্যাসের ঘটনার কাল পরিধি।
  • উপন্যাসটি বলীরামপুর জুটমিলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ঘটনা অবলম্বনে রচিত । 
  • উপন্যাসটি  ১৩৬৫ বঙ্গাব্দের (১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে) ভাদ্রমাসে ‘মাতৃভূমি’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়।
  • কিছুদিন প্রকাশিত হওয়ার পর উপন্যাসটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায় । 
  • পরে উপন্যাসটি ‘মাসিক বসুমতী’ পত্রিকায় ‘মীনাকুমারী’ নামে প্রকাশিত হয় । 
  • উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ‘চিত্রগুপ্তের ফাইল’ নামে । 
  • এটি মূলত রাজনৈতিক উপন্যাস । 
(f) ‘দিগভ্রান্ত’ ঃ
  • ‘এটি সতীনাথ ভাদুড়ীর  শেষ উপন্যাস ।
  • এই উপন্যাসে সুবোধ ডাক্তার, অতসীবালা, সুশীলমনি একে অপরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েও কীভাবে আবার তারা নিজেদেরকে নিজেরা ফিরে পেল, তার কাহিনি বিবৃত হয়েছে।
  • উপন্যাসটির পরিচ্ছেদ সংখ্যা - ২৩টি ।
  • উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিহ হয় - ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দে ।
  • সতীনাথের মৃত্যুর পন উপন্যাসটি প্রকাশিত হয় ।
  • বৃন্দাবনের বৈষ্ণবীয় আশ্রম থেকে এর কাহিনী সংগ্রহ করেন ।
উপন্যাস সাহিত্যে সতীনাথের গুরুত্ব ঃ
        বাংলা উপন্যাস সাহিত্যে সতীনাথ ভাদুড়ীর গুরুত্ব অপরিসীম। 
১। সতীনাথ ভাদুড়ী আধুনিক বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লেখক। বাংলা উপন্যাস সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি এক বিরল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
২। বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক উপন্যাসগুলোর মধ্যে 'জাগরী' অন্যতম। 
৩। অধ্যাপক সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “দিগ্‌ভ্রান্ত'-এর মতো পারিবারিক উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে নেই।”
৪। ‘ গ্রাম-সমাজের পরিবর্তন রচনায় সতীনাথ একান্তভাবে তারাশঙ্করের উত্তরসূরী।

No comments